993 বার লেখাটি পঠিত হয়েছে ~~~
আচ্ছা, মৌমাছি শুনতেই আমাদের কী মনে পড়ে? চাকভাঙ্গা মধু, গুনগুন গুঞ্জন, কিছু গান, আর জীবন বিজ্ঞানের বইতে পড়া সেই রাণী মৌমাছি-শ্রমিক মৌমাছিদের সামাজিকতার গল্পগুলো। আর একবার দুবার কামড় খাওয়ার অভিজ্ঞতা থাকলে, অবশ্যই, হুলের কথাও কারোর মনে পড়তে পারে! কিন্তু ‘গুঞ্জরিয়া আসে অলি পুঞ্জে পুঞ্জে ধেয়ে’-র বাইরেও মানবসভ্যতার অস্তিত্ব রক্ষার জন্য এদের কী ভূমিকা, তা বোধহয় আমাদের অনেকেরই অজানা।
মৌমাছি পরাগ সংযোগী পতঙ্গ। পরাগ সংযোগী হিসেবে মৌমাছির গুরুত্ব অপরিসীম, কারণ আমাদের খাদ্য সুরক্ষা তথা বিশ্ব অর্থনীতি এদের সাথে ওতপ্রতভাবে জড়িয়ে। পরাগ সংযোগে যে নতুন ফুল, ফল জন্মায় তাইই নয়, নতুন গাছপালা পরিবেশ তৈরি হয় যা বহু জীবজন্তুর আশ্রয়স্থল। বাস্তুতন্ত্রে মৌমাছিরা হল ‘কিস্টোন প্রজাতি’ (Keystone species) অর্থাৎ যেই প্রজাতির ওপর খাদ্য- বাসস্থান এর জন্যে নির্ভরশীল আরও বহু প্রজাতি। বিগত কয়েক দশক ধরে জীব বৈচিত্র্য ব্যাপক হারে ধ্বংসের মুখে। ফলে হারিয়ে যেতে বসেছে এই মৌমাছি আর বিভিন্ন পরাগ সংযোগী কীট-পতঙ্গ। আর এই হারিয়ে যাওয়া কৃষিকার্য্য, উদ্যানবিদ্যা, অর্থনীতি, সবকিছুর পক্ষেই নিয়ে আসছে মারাত্মক বিপদ। এই ছোট্ট মৌমাছিদের ওপর সারা পৃথিবীর হাজার হাজার বিলিয়ন ডলারের অর্থনীতি নির্ভরশীল! কর্ণাটক ইউনিভার্সিটি অব এগ্রিকালচারাল সায়েন্স-র গবেষণা অনুযায়ী, ভারতের ১৬০ মিলিয়ন হেক্টর কৃষিজমির মধ্যে প্রায় ৫৫ মিলিয়ন হেক্টর জমির চাষ-আবাদ সরাসরি মৌমাছিদের ওপর নির্ভর করে। বলাই বাহুল্য, যে এই বিপুল কৃষিক্ষেত্র যদি মৌমাছির অভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তাহলে এই ক্ষেত্রের সাথে জড়িয়ে থাকা কৃষক থেকে শুরু করে এর ওপর নির্ভরশীল খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ শিল্প, রেস্তোরাঁ এমনকি বস্ত্রশিল্প সবেতেই এর মারাত্মক প্রভাব পড়বে। দেখা দেবে খাদ্যসঙ্কট। এ কথা ভেবেই হয়ত আইনস্টাইন একবার বলেছিলেন, পৃথিবী থেকে যদি শুধুমাত্র এই পরাগ সংযোগী কীট-পতঙ্গরা হারিয়ে যায় তাহলে মাত্র তিন বছর লাগবে গোটা মানব সভ্যতা ধ্বংস হতে!
শুধুমাত্র মৌমাছি আর পোকামাকড়ই তো না, আমরা যেই যুগে বাস করছি, জীববিজ্ঞানীদের ভাষায় এটা ষষ্ঠ গণ বিলুপ্তি যুগ (Mass Extinction)। যখন খুব অল্প সময়ের মধ্যে যদি পৃথিবীর তিন চতুর্থাংশ প্রজাতি অবলুপ্ত হয়, সেটাকে বলা হয় ‘গণ বিলুপ্তি’। এর আগে পাঁচবার পৃথিবীতে এমন গণ বিলুপ্তি দেখা গেছে। পঞ্চম বিলুপ্তিতে ডাইনোসর অবলুপ্ত হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু আগের পাঁচ বারের সাথে এবারের চরিত্রগত তফাত হল, আগের পাঁচবারই এই অবলুপ্তির মূল কারন ছিল, কোন না কোন ভয়ঙ্কর প্রাকৃতিক দুর্যোগ। কিন্তু এইবারের আবলুপ্তির দায় পুরোপুরি মানুষের।
একশো পঁয়তাল্লিশজন বিশেষজ্ঞ পঞ্চাশটি দেশের পনেরো হাজার সরকারি তথ্য ও বিভিন্ন গবেষণাগারের তথ্যসুত্র (UN Global Assessment Report, 2019 ) একত্রিত করে দেখেছেন, প্রায় দশ লাখ প্রজাতি বিলুপ্তির পথে। ২৯৪০০ টি প্রজাতির কেবলমাত্র এক হাজারটি করে প্রাণী বেঁচে আছে, যাদের মধ্যে পাঁচশ পনেরোটি প্রজাতি খুব শীঘ্রই বিলুপ্ত হয়ে যাবে আর কিছুদিনের মধ্যেই। কারা আছে এই বিলুপ্তির পথে? শয়ে শয়ে গাছপালা, পোকামাকড়, অমেরুদণ্ডী থেকে মেরুদণ্ডী, ছোট বড় প্রচুর প্রজাতি। ২০১৮ এর লিভিং প্ল্যানেট তথ্য অনুসারে, বিশ্বজুড়ে পুঁজিবাদের যে অনিয়ন্ত্রিত দাপাদাপি, তার জেরে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে পৃথিবীর আকাশ, বাতাস, মাটি, সমুদ্র, জলা ভূমি, জঙ্গল– সমস্ত কিছুই। যেই প্রকৃতি আমাদের অর্থনীতিকে ধারণ করে রাখে, তাকেই অবলীলায় কেমন আমরা ধ্বংস করে চলেছি! যে গাছের ডালে বসে আছি, সেই ডালটাতেই আমরা ক্রমাগত কুড়ুল মেরে চলেছি।
জঙ্গল কেটে শিল্প, বাস্তুজমি এবং কৃষিজমি বানানো, প্রয়োজনারিক্ত মৎস্যশিকার, চোরা শিকার ও জীব-জন্তুর অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের চোরাচালান, রাস্তা বানিয়ে জঙ্গল বিভাজন, এবং সর্বোপরি দূষণ এই ব্যাপক হারে অবলুপ্তির জন্যে দায়ী। খুব বেশী আগেকার কথা না, তিন-চার দশক আগেও শহরে বা মফঃস্বলের পাড়ায় শেয়ালের ডাক শোনা যেত, বাদুড় চামচিকের দেখা মিলত, ভাগাড়ে শকুন বা গঙ্গায় ডলফিন দেখা যেত। আজ সেসব রূপকথার গল্পের মত ব্যাপার!
প্রশ্ন উঠতে পারে, মানুষ যে জঙ্গল কেটে তার সভ্যতা তৈরি করবে, সেটাই তো স্বাভাবিক! মানব সভ্যতার গোড়া থেকেই তাই হয়েছে। পরিবেশের ওপর দখলদারি তো চলছিলই সভ্যতার উষালগ্ন থেকে, কিন্তু শিল্পবিল্পবের পর থেকে তা বহুগুণে বৃদ্ধি পায়, আর বিগত পঞ্চাশ বছরে সেটা সমস্ত মাত্রা অতিক্রম করেছে। গত পঞ্চাশ বছরে লোক সংখ্যা আর নগরায়ন দুইই প্রায় দ্বিগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। স্বভাবতই কোপ পড়েছে অরণ্যে তথা বিভিন্ন জীবজন্তুর বাসভূমিতে। গোরু জাতীয় গবাদি পশু, সয়াবিন চাষ, পাম তেল আর কাঠ- এই চারটি বাণিজ্যের কারণে পৃথিবী থেকে প্রতি বছর প্রায় সুইৎজারল্যান্ডের আয়তনের সমান চল্লিশ হাজার বর্গ কিলোমিটার অরণ্য হারিয়ে যাচ্ছে। খালি সাড়ে চার লাখ বর্গ কিলোমিটার আমাজন অরণ্য ধ্বংস করা হয়েছে গবাদি পশুপালন ও সয়াবিন চাষের জন্যে। এখনও তা হয়েই চলেছে।
জলজ প্রাণীদের অবস্থা আরো শোচনীয়। প্রতি বছর ত্রিশ- চল্লিশ কোটি টন ভারি ধাতু, রাসায়নিক, বিষাক্ত লবণ, ময়লা জলে ফেলা হয়। আশি লাখ টন প্লাস্টিক প্রতি বছর জমা হচ্ছে সমুদ্র গর্ভে। মানুষের ব্যবহার করা প্লাস্টিকের মাত্র পনেরো শতাংশ বাদ দিলে বাকি পুরোটাই জমা হয়ে চলেছে সেখানে। ‘Great Pacific Garbage Patch’ প্রশান্ত মহাসাগর জুড়ে ভেসে থাকা প্লাস্টিকের এক প্রকাণ্ড ভাগাড় যেন! শুধু জলজ প্রাণীদেরই নয়, সমুদ্রের স্বাভাবিক লবণেরও চরিত্র পালটে দিতে পারে এই প্লাস্টিক। বিষাক্ত পদার্থকে চুম্বকের মত সমুদ্রের প্লাস্টিকের গায়ে আটকে থাকে। এই প্লাস্টিকের ছোট ছোট টুকরোগুলো (Microplastic) ছোট–বড় মাছ-কচ্ছপের খাবার হিসেবে পেটে যাচ্ছে। ৯০% জলজ প্রাণীই কোন না কোন ভাবে এই প্লাস্টিক খেয়ে ফেলছে। এখনই যদি আটকানো না যায়, ২০৫০ সালের মধ্যে ৯৯% সামুদ্রিক প্রাণীদের শরীরে প্লাস্টিক ঢুকে যাবে। এবং এর ফলে ধ্বংস হবে অসংখ্য প্রজাতি। সাথে জুড়েছে উষ্ণায়নের প্রভাব। মাত্র গত তিরিশ বছরেই প্রায় পঞ্চাশ শতাংশ অগভীর প্রবাল প্রাচীর ধ্বংস হয়ে গেছে। যাকে কিনা বলা হত সমুদ্রের জঙ্গল, যেখানে অনেক প্রাণী একসাথে থাকতে পারত। সুতরাং বাসস্থান শেষের সাথে সাথেই শেষ হচ্ছে প্রবাল নির্ভর জলজ প্রাণীরাও।
তবে বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন এখনও সবকিছু শেষ হয়ে যায়নি। যদি আমরা প্রতিটা পদক্ষেপে পরিবেশ নিয়ে চিন্তা করি, তবে এখনো কিছু আশা আছে। শুধুমাত্র জিডিপির তাৎক্ষণিক উত্তুঙ্গ শিখরের দিকে না তাকিয়ে না, আকাশ, মাটি, জল, বৃক্ষরাজি, ছোট বড় প্রাণী, এমনকি কীটপতঙ্গকেও সমান গুরুত্ব দিতে হবে। প্রজাতির বিলুপ্তিকরন শুধু মাত্র আরেকটা পরিবেশের আলোচনার বিষয় নয়, এটা আমাদের অর্থনীতির প্রশ্ন, উন্নয়নের প্রশ্ন, অস্তিত্বরক্ষার প্রশ্ন, একইসাথে আমাদের সামাজিক দায়বদ্ধতারও প্রশ্ন। মনে রাখতে হবে, একেকটা প্রজাতির বিলুপ্তি আসলে কিন্তু আমাদেরকেও অস্তিত্বের সংকটে ফেলে দিচ্ছে ক্রমাগত।
—————————–
~ কলমে এলেবেলের অতিথি দেবযানী পাল ~
দেবযানী কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অণুজীববিদ্যায় স্নাতক ও পরিবেশবিদ্যায় স্নাতকোত্তর করে বর্তমানে ব্যাঙ্গালোর আর্মি পাবলিক স্কুলের শিক্ষিকা।
► লেখা ভাল লাগলে অবশ্যই লাইক করুন, কমেন্ট করুন, আর সকলের সাথে শেয়ার করে সকলকে পড়ার সুযোগ করে দিন।
► এলেবেলেকে ফলো করুন।
খুব সুন্দর হয়েছে দেবযানী। পরিবেশ রক্ষায় আমাদের সবাই কে সচেষ্ট হতে হবে। বিশেষ করে কমবয়সি দের। এখন ও সময় আছে; হতাশ হয়োনা। আমি এখন কিছুদিনের জন্য ব্যাঙ্গালোরে আছি। Dibyasree Republic of Whitefield এ।
আপনার মতামতের জন্যে ধন্যবাদ। দেবযানীকে আপনার কথা পৌঁছে দিচ্ছি।
অনেক ধন্যবাদ। পরিবেশ নিয়ে আপনার সদর্থক চিন্তা খুব ভালো লাগল। আমিও আশাবাদী যে সকলে মিলে চেষ্টা করলে নিশ্চয়ই এই ভয়াবহতা কিছুটা হলেও আটকাতে পারব!
আপনার নামটা কোনও কারণে এখানে দেখাচ্ছেনা, তাই ব্যাঙ্গালোরের কথাটা ঠিক বুঝে উঠতে পারলাম না। যেখানেই থাকুন, ভালো থাকবেন।