জীবন্ত থার্মোমিটার
“ধুর! কোথায় এখন প্যাংগং লেকের ধারে থ্রি ইডিয়টস্ স্টাইলে সেলফি তুলতাম, আর কোথায় এসে মশার কামড় আর ঝিঁঝির গান শুনছি।” একরাশ হতাশা নিয়ে বলল ঋক। করোনার প্রকোপে তিন বন্ধুর দু বছরের প্ল্যান লাদাখের বাইক ট্রিপ পুরো ভেস্তে গেছে। কিন্তু ঐ যে কথায় আছে, পায়ের নিচে সরষে, ঘরে কি আর মন টেকে! অগত্যা দুধের স্বাদ ঘোলে মেটাতে সৈকতের মামার বাড়িতে হাজির তিন বন্ধু। পুরুলিয়ার কাছে শুকনো পাহাড় আর জঙ্গল ঘেরা এক গ্রামে ইংরেজ আমলের পোড়ো বাড়ি। কর্মসূত্রে বাড়ির প্রত্যেক সদস্যই বিভিন্ন শহরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে। দু-পাঁচ বছরে হয়তো এক বার বাড়ির তালা খোলা হয়। তাই সাপ, বাদুড়, পেঁচা, পায়রা এরাই এখন এ বাড়ির স্থায়ী বাসিন্দা। একজন কেয়ারটেকার আছেন বটে, তবে তিনি মহা ফাঁকিবাজ। সৈকতদের আসার কথা শুনে, এসে, কোনরকমে ধুলো ঝেড়ে, দেশি মুরগির ঝোল আর গরম ভাত রেঁধে, হ্যারিকেন ধরিয়ে দিয়ে পালিয়েছে।
হঠাৎ রনি চিল্লে উঠলো, “ধরেছি ব্যাটাকে, এবার তোর ডানা গুলো খুলে নেব, দেখি আর কত চিৎকার করিস!”
ঋক আর সৈকত ভয়ে লাফিয়ে দু হাত দূরে সরে গিয়ে বলে, “আরে কার ডানা খুলে নিবি? সাপেরা আবার কবে থেকে উড়তে শুরু করল?”
রনি গব্বর সিং র মতো অট্টহাস্য করে উঠলো, “হা হা হা হা! আরে সাপ নয়, ঝিঁঝি! ব্যাটা কান-মাথা খেয়ে নিল চিৎকার করে করে। বনের গুলোকে তো ধরতে পারবো না, এটা কে ঘর থেকে বার করলে তবুও রাত্রের ঘুমটা হবে।”
– দাঁড়া দাঁড়া ওটাকে মারিস না। একটা আইডিয়া এসেছে মাথায়। সেদিন ফেসবুকে ‘এলেবেলের’ পেজে পড়ছিলাম ঝিঁঝির ডাক শুনে নাকি তাপমাত্রা মেপে ফেলা যায়। চল একটা এক্সপেরিমেন্ট করে দেখা যাক। বেশ মজার হবে ব্যাপারটা।
ঋকের মুখের কথা কেড়ে নিয়ে সৈকত বলল, “তুই বলতে চাইছিস ডোলবারের সূত্রটা?”
রনি মাঝ থেকে ফুট কাটলো, “আরে কি বলছিস তোরা? আমার মাথায় কিছুই ঢুকছে না! ঝিঁঝিপোকা, তাপমাত্রা! আরে, যোগাযোগটা কোথায়? আর কীসের এক্সপেরিমেন্ট?”
– বলছি বলছি তুই আগে ঝিঁঝিটাকে এক কোণে ছেড়ে দিয়ে আয়, লক্ষ্য রাখিস যেন উড়ে না পালায়।
সৈকতের কথা মত রনি ঝিঁঝিটাকে ঘরের এক কোণে ছেড়ে দিয়ে এসে বসল।
“শোন তবে,” সৈকত শুরু করল, “বাকি পতঙ্গদের মত ঝিঁঝি পোকারাও শীতল রক্ত যুক্ত প্রাণী। তাই ওদের শরীরে কোন নির্দিষ্ট তাপমাত্রা বজায় থাকে না। কিন্তু স্তন্যপায়ী এবং পাখিদের ন্যায় উষ্ণ রক্তযুক্ত প্রাণীদের দেহে সর্বদা একটি নির্দিষ্ট তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রিত হয়। আমরা প্রত্যেকেই যা খাবার খাই, তা শরীরের মধ্যে ঘটে যাওয়া বিভিন্ন রাসায়নিক বিক্রিয়ার দ্বারা ভেঙে গিয়ে শক্তি উৎপন্ন করে। এই শক্তিকে কাজে লাগিয়ে আমরা দৈনন্দিন জীবনের সমস্ত কাজকর্ম করতে পারি। কিন্তু ঝিঁঝিপোকা বা বাকি পতঙ্গদের দেহে ঠিক এমনটা ঘটে না। ওদের শরীরে ওই একই পদ্ধতিতে যে পরিমাণ শক্তি উৎপন্ন হয় তা ওদের কে সচল রাখার পক্ষে যথেষ্ট নয়। আর তাই ওদেরকে বাইরের পরিবেশের তাপমাত্রার উপর নির্ভর করতে হয়, পরিবেশের তাপমাত্রা কম হলে ওরাও যেন ঝিমিয়ে পড়ে।”
“কিন্তু তাপমাত্রার সাথে ঝিঁঝিপোকার সক্রিয় হয়ে ওঠার কারণটা ঠিক বুঝলাম না” – ঋক প্রশ্ন করল।
– আরে ছোটবেলার কেমিস্ট্রি বইতে বিজ্ঞানী আরহেনিয়াসের সমীকরণ পড়িস নি? যে, উষ্ণতা বাড়লে রাসায়নিক বিক্রিয়ার হার বেড়ে যায়। ঠিক সে কারণেই বেশি তাপমাত্রায় যেকোনো ফল তাড়াতাড়ি পেকে যায় বা খাবার দাবার নষ্ট হয়ে যায়। সবকিছুর পেছনেই ঐ একই কারণ, খাবার-দাবার ফলমূল বা আমাদের শরীর সবই তো বিভিন্ন রকমের পদার্থের অণু-পরমাণু নিয়ে তৈরি আর তাপ বৃদ্ধি পাওয়া মানে শক্তি বৃদ্ধি পাওয়া। কারণ তাপ তো এক প্রকার শক্তি। আর এই শক্তি বৃদ্ধি পেলেই ওদের মধ্যে ছোটাছুটি ধাক্কাধাক্কি বেড়ে যায় অর্থাৎ সক্রিয়তা বৃদ্ধি পায়। এজন্যই তো গরমকালে দেখবি, সাপ, পোকা-মাকড় এদের আনাগোনা বেড়ে যায়। বেশি উষ্ণতায় ঝিঁঝির শরীরে পেশীর সংকোচন প্রসারণ বেড়ে যায়, ফলে ওরা আরো বেশি ডাকাডাকি জুড়ে দেয়।”
রনি এবার বেশ অবাক-—পেশী সংকোচন এর সাথে ডাকাডাকির কি সম্পর্ক?
সৈকত বিজ্ঞের মতো বলল, “আছে বস, সম্পর্ক আছে। ঝিঁঝিপোকারা কিন্তু মুখ দিয়ে ওই রকম আওয়াজ করে না। পুরুষ ঝিঁঝি পোকার ডানাতে চিরুনির মতো গঠন থাকে। দুটো পাখনা কে একসাথে ঘষে ঘষে ওই রকম আওয়াজ করে ওরা। আর সেটাও কখন জানিস? সঙ্গী কোন স্ত্রী ঝিঁঝিপোকা কে ইমপ্রেস করতে।আবার কখনো প্রতিদ্বন্দ্বী অন্য এক পুরুষ ঝিঁঝিকে ভয় দেখাতে ওই রকম আওয়াজ করে। আর ওরা যেহেতু নিশাচর পতঙ্গ তাই নিশি রাতেই যত ডাকাডাকি!
“আইব্বাস, এতো দারুণ জিনিস জানলাম আজ! থ্যাংকু সৈকত,” রনি বলে উঠলো।
– দাঁড়া দাঁড়া! এখনও তো গল্প বাকি। সময়টা ১৮৯৭ সাল। পদার্থবিদ ডোলবার লক্ষ্য করলেন যে ঝিঁঝিরা একটা নির্দিষ্ট হারে ডাকে। পতঙ্গদের গতিবিধির উপর পরিবেশের উষ্ণতার যে একটা প্রভাব রয়েছে তা তাঁর অজানা ছিল না। সুতরাং ঝিঁঝির ডাক কে কাজে লাগিয়ে পরিবেশের উষ্ণতা মেপে ফেলা যায় কিনা তা জানতে তিনি রীতিমতো গবেষণা শুরু করলেন এবং সফলও হলেন। বের করে ফেললেন খুব সহজ দুটি সূত্র। প্রথমটি ডিগ্রি ফারেনহাইট স্কেলে উষ্ণতা মাপার এবং দ্বিতীয়টি ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড স্কেলের উষ্ণতা মাপার।
রনি একটু অবাক হয়ে প্রশ্ন করল, “সেটা আবার কেমন? মানে সূত্রটা কীভাবে কাজে লাগাবো?” সৈকত হেসে বলল।
আরে ভীষণই সোজা, ১৫ সেকেন্ডে মোট যতগুলো ডাক শুনতে পাবি তার সাথে চল্লিশ যোগ করলেই মোটামুটি পেয়ে যাবি ফারেনহাইট স্কেলে উষ্ণতার মান। আর সেলসিয়াস স্কেলের ক্ষেত্রে সূত্র টা একটু আলাদা সেক্ষেত্রে প্রথমে ২৫ সেকেন্ডে মোট যতগুলো ঝি ডাক শুনবি তাকে তিন দিয়ে ভাগ করবি, সেই ভাগফলের সাথে চার যোগ করলে পেয়ে যাবি উষ্ণতার মান। তবে সব ক্ষেত্রেই কিন্তু একটা ঝিঁঝির ডাক গুনতে হবে, একের বেশী নয়।”
সব শুনে রনি আর রিক বেশ মজা পেয়েছে। দুজনেই একসাথে সৈকতকে প্রশ্ন করল, “কিন্তু তুই এত কিছু কী করে জানলি?”
সৈকত এবার বেশ বিজ্ঞের মতো ভাব করে বলল, “বোনের স্কুলে কিছুদিন আগে একটা প্রজেক্ট করতে দিয়েছিল। বিষয় ছিল যেকোনো যুগান্তকারী আবিষ্কার। বোন টেলিফোনের আবিষ্কার নিয়ে লিখছিলো, তো তখন ওর প্রজেক্টে ওকে হেল্প করার জন্য টেলিফোনের আবিষ্কার নিয়ে পড়তে গিয়ে জানলাম ডোলবারের নাম। উনি নাকি গ্রাহাম বেলের ১১ বছর আগেই টেলিফোন রিসিভার আবিষ্কার করেছিলেন। ফলে, গ্রাহাম বেল যখন পেটেন্ট করতে গেলেন, তখন শুরু হল ঝামেলা। সেই গন্ডগোল শেষ অব্দি গিয়ে পৌঁছল কোর্টে। কিন্তু, ডোলবার তার আবিষ্কার এর প্রমাণ দেখাতে পারেননি, আর তাই কেসে হেরেও যান এবং টেলিফোনের আবিষ্কারক এর পেটেন্ট চলে যায় গ্রাহাম বেলের হাতে।
“হুম, সত্যিই ভীষণ দুর্ভাগ্যের ব্যাপার,” মাথা নাড়লো ঋক। “যাই হোক চল তবে আমরাও একবার পরীক্ষা করে দেখি ব্যাপারটা কতটা সত্যি,” রনি ভীষণ উৎসাহের সাথে প্রস্তাব দিল।ঝিঁঝিটা তখনো ঘরের কোনায় ঘুরে বেড়াচ্ছিল ঠিক যেন ওদের পরীক্ষার থার্মোমিটার হওয়ার অপেক্ষায়। সৈকত একটু গম্ভীর হয়ে বললো “তোরা কিন্তু এমনটা আশা করিস না যে থার্মোমিটারের মত একদম কাঁটায় কাঁটায় সঠিক উষ্ণতার পাঠ পাবি। যতই হোক ঝিঁঝি তো কোন যন্ত্র নয়, একটা প্রাণী মাত্র। আবার ওদের অনেক প্রজাতিও আছে। সুতরাং উষ্ণতার তারতম্যের সাথে সাথে ওদের ডাকার ধরনও পাল্টাবে। আজ এখানে বসে মে মাসের গরমে যেরকম ডাক শুনবি কাশ্মীরের কোন গ্রামে শীতের রাতে বসে কিন্তু অন্যরকম ডাক শুনতে পাবি। তাছাড়াও ধর তুই কোন শীতের রাত্রে বন্ধ ঘরে বসে পরীক্ষাটা করছিস সে ক্ষেত্রে তোর ঘরের থার্মোমিটারের পাঠ আর ঝিঁঝির ডাক শুনে গণনা করা উষ্ণতার পাঠ অবশ্যই আলাদা হবে। কারণ বন্ধ ঘরের তাপমাত্রা আর খোলা মাঠে যেখানে ঝিঁঝি ডাকছে সেখানের তাপমাত্রা আলাদা হবে। দেখা গেছে ৫৫ থেকে ১০০ ডিগ্রী ফারেনহাইট উষ্ণতার মধ্যে ঝিঁঝিপোকা বেশি সক্রিয় থাকে। তবে সেক্ষেত্রে বেশ কয়েক বার ঝিঁঝির ডাকের পাঠ নিয়ে তার গড় করলে অনেক সঠিক মান পাওয়া সম্ভব ।”
“বেশ বুঝলাম সবই। চল তবে এবার আমরাও লেগে পড়ি দেখা যাক ঠিক কতটা সঠিক ভাবে উষ্ণতা গণনা করা সম্ভব হয়,” রনি যেন আর তর সইতে পারছিলো না।
সৈকত হাসতে হাসতে বলল, “তুই ওটাকে যা ভয় দেখিয়েছিস, দেখ ও আর ডাকছে নাকি!”
ঘড়িতে তখন রাত ১টা। কিন্তু তাতে কী? বিজ্ঞান যে কত মজার তা ওদের ছেলেমানুষি না দেখলে হয়তো বিশ্বাসই হতো না।
—————————–
~ কলমে এলেবেলে সোমাশ্রী ~
► লেখা ভাল লাগলে অবশ্যই লাইক করুন, কমেন্ট করুন, আর সকলের সাথে শেয়ার করে সকলকে পড়ার সুযোগ করে দিন।
► এলেবেলেকে ফলো করুন।
Darun lekha!!!
Apnader kach theke onek notun jante parchi.Thanks
আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ।
আমাদের পাশে থাকার জন্যে আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ।
Besh bhalo …informative o….Apart from that lekhar dhoron ta besh bhalo…..
আপনার অনুপ্রেরণায় আমরা (ও বিশেষত লেখিকা) খুব উৎসাহিত হয়েছি। আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ।