ছোট্ট অত্রি সত্যিই ছোট্ট মানুষ। আকারে ছোটখাটো তা বলছি না, ওর পরিসর ছোট; অত্রি তার নিজের ছোটখাটো জগতে নিজের নিয়মে বিচরণ করে। এইতো সবে আট বছর বয়স, বাড়ির কাছের স্কুলে ক্লাস থ্রি তে পড়ে। ঠিক কতটা পড়ে তা বোঝা বেশ কষ্টকর, কারন অত্রিবাবু এখন মোটামুটিভাবে পেন্সিল, পেন, ক্রেয়ন ধরতে শিখেছে, খাতায় মনের সুখে আঁক কাটে, সুন্দর রঙ করে; তবে ক্লাসে টিচারের কথা শুনে শুনে সেই অনুযায়ী কাজ করতে তার ভারি অসুবিধা। অত্রিবাবু ক্লাসের একদম শেষ বেঞ্চে, প্রায় একা সারাদিন বসে থাকে, নিজের মত খেলে। টিচাররা ওকে কোন কাজ করার কথা বললেও সে কিন্তু তার নিজের নিয়মেই চলে। কেউ কেউ বলে অত্রি বোকা, কিচ্ছু বোঝেনা। ক্লাসের বন্ধুরা খেপায়, রাগায়, আর অত্রি রেগে যায়! বেঞ্চে যেভাবে সে ব্যাগ রাখে, যেভাবে পেন্সিলগুলো সাজিয়ে রাখে তার একটু নড়চড় হলেই খুব, খুব রাগ হয়; টিফিনের সময় ক্লাসের বন্ধুরা যখন ওকে ঘিরে ধরে ওর খাওয়া দেখতে থাকে, ওর গায়ে হাত দেয় – দারুণ অস্বস্তি হয়। কেউ জোরে ওর কানে “কু…” করে দিলে খুব কষ্ট। গায়ে হাত দেওয়া, জড়িয়ে ধরা, ওর জিনিসে হাত দেওয়া, জোর আওয়াজ, জোরালো আলো – এই সব অত্রি দারুন ভয় পায়। চেঁচিয়ে, কেঁদে, জিনিসপত্র ছুঁড়ে, কাছে যে থাকবে তাকে মেরে – ধরে – সে এক একাকার কাণ্ড। অত্রির মা – বাবার খুব মন খারাপ – অত্রিবাবু যে অনেকটা আলাদা সবার চেয়ে! অত্রির যখন পাঁচ বছর বয়স তখন অত্রির বাবা মা প্রথম জানতে পেরেছিলেন যে অত্রির এধরনের আচরণের পিছনের কারণের নাম হল – “অটিজম্ স্পেক্ট্রাম ডিসঅর্ডার”। আরও ছোটবেলায় যখন অত্রি নিজের মত একা একা খেলত, কথা বলত না, তখন ঠাম্মা – দাদু, দাদান – দিদুন সব্বাই বলত, বড় হলে সব ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু যত বড় হতে লাগল তত বেশী আশপাশ থেকে যেন বিচ্ছিন্ন হয়ে যেতে লাগল।
জন্মের সময় থেকেই প্রত্যেক শিশুর শারীরিক বিকাশের সাথে সাথেই মনেরও বিকাশ হতে থাকে। কোনবয়সে বাচ্চারা শুয়ে থাকা অবস্থায় উল্টাতে শিখবে, নিজে নিজে বসতে শিখবে, দাঁড়াতে পারবে, শব্দ উচ্চারণ করবে, কথা বলতে শিখবে – এই সব কিছুরই একটা মাপকাঠি আছে। বেশীরভাগ বাচ্চাদের ক্ষেত্রেই এই মাপকাঠি অনুযায়ী বাচ্চার শারীরিক এবং মানসিক (বুদ্ধির বিকাশ, জটিল অনুভুতির বিকাশ, আর আচরনের পরিবর্তন) বিকাশ হয়। অটিজম্ স্পেক্ট্রাম ডিসঅর্ডার – একটি বিকাশজনিত সমস্যা। মনোবিজ্ঞানীরা বলছেন, যাঁদের অটিজম্ স্পেক্ট্রাম ডিসঅর্ডার আছে, তাঁদের সাধারনতঃ –
কথাবার্তার মধ্যে দিয়ে মনের কথা প্রকাশ করতে, কথোপকথন করতে, অন্যের কথা বুঝে সেইমত কাজ করতে বেশ সমস্যা হয়। যেকোনো খেলার বা কাজের নিয়ম বুঝে সেই অনুযায়ী খেলতে বা কাজ করতে অসুবিধা হয়।
অন্য কারোর কথা শোনা, অন্যদের সাথে মিলেমিশে কোন কাজ করা, নিজের আনন্দ বা দুঃখ অন্যের সাথে ভাগ করে নেওয়া, অন্যের আনন্দে সামিল হওয়া – এসব ক্ষেত্রে অসুবিধা হয়। কোন কাজ বা বিষয় নিজের নিয়ম মত, মনের মত না হলে অত্যন্ত অসহিষ্ণু হয়ে যায়, নিয়মের পরিবর্তন হলে তার সাথে মানিয়ে নিতে ভারি অসুবিধা হয়।
তাঁরা কোন বিশেষ আচরণ বারে বারে করতে থাকে, কোন শব্দ শুনে সেই শব্দকেই রিপিট করে (শব্দের মানে না বুঝেই), কোন বিশেষ আলো, শব্দ, গন্ধ বা স্বাদ – এর প্রতি বেশীমাত্রায় বা খুব অল্প মাত্রায় সংবেদনশীল হয়। রোজকার কাজকর্ম করতেও সমস্যা হতে পারে।
তবে সবারই যে এইসব লক্ষণগুলো সমানভাবে থাকবে তা কিন্তু নয়। এই ব্যাপারটা কিন্তু বেশ অদ্ভুত। যেমন, এই আমাদের অত্রিবাবু, একটা শব্দও মুখে উচ্চারণ করেনা, হাবে ভাবে নিজের প্রয়োজন বোঝায়। আবার অত্রির স্কুলেই পড়ে সৃজনী নিজের মনে সারাদিন প্রচুর কথা বলে যাচ্ছে, গান করছে, কিন্তু কারোর সাথে কথা বলা বা গল্প করা – সেটা সে পারছেনা। কেউ শারীরিক ভাবে খুব ফিট্, আবার কারোর শারীরিক জড়তা থাকে। অনেক মানুষ যাঁদের অটিজম্ আছে তাঁদের কিন্তু অনেক সময় দেখলে সমস্যার কথা কিছু বোঝাই যায়না। এই কারনেই এই অবস্থাকে ‘স্পেক্ট্রাম’ বা ‘বর্ণালী’ বলা হয়। অটিজম্ এর সাথে অনেক সময় আরও অন্য ধরনের সমস্যা থাকে লেজুড় হিসাবে, যেমন মনোযোগের অভাব ও অতিমাত্রায় চঞ্চলতা (Attention Deficit and Hyperactivity), এপিলেপ্সি, ঘুমের সমস্যা, হজমের গোলমাল, বা বুদ্ধির বিকাশজনিত সমস্যা (Intellectual Disability) ইত্যাদি। মনোবিজ্ঞানীরা নানান পরীক্ষা নিরীক্ষার (সাইকোমেট্রিক টেস্ট) মাধ্যমে দেখতে পান যে, দুনিয়ার বেশীরভাগ মানুষের গড় বুদ্ধ্যঙ্ক (IQ) – ৯০ থেকে ১১০ এর মধ্যে। অটিজম্ আছে এমন মানুষের ক্ষেত্রে দেখা যায় এঁদের বুদ্ধি বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই সাধারণ আর পাঁচ জনের মত, আবার কারোর কারোর ক্ষেত্রে সাধারণের থেকে বেশী (বুদ্ধ্যঙ্ক – ১১০ এর বেশী), আবার যদি অটিজম্ এর সাথে লেজুড় হিসাবে বুদ্ধির বিকাশজনিত সমস্যা থাকে তাহলে আবার বুদ্ধ্যঙ্ক ৯০ এর নিচে হয়; যদিও মনোবিদরা এটাও বলেন যে এই IQ কখনই মানুষের বুদ্ধির পরিমাপ নির্দিষ্ট করে নির্ধারণ করতে পারেনা। যেকোনো জিনিসের খুঁটিনাটি, বা সূক্ষ্ম বিষয়ের প্রতি তারা মনোযোগী হয়। যেমন, পার্কে গিয়ে ছোট্ট অত্রি যখন প্রথম ঢেঁকি দেখেছিল, তখন খুব মন দিয়ে বোঝার চেষ্টা করছিল কিভাবে ঢেঁকির একটা প্রান্ত নিচে নেমে গেলে আরেকটা প্রান্ত উপরের দিকে উঠে যায়; ঢেঁকি চড়ার থেকে এই ব্যাপারটা তার বেশি অদ্ভুত লেগেছিল। একটা খুব মজার বিষয় হল, অটিজম্ আছে এমন মানুষদের অনেক সময় দেখা যায় কোন বিশেষ বিষয়ে পারদর্শিতা আছে; অনেকগুলো না -পারার মধ্যে কিছু চমকে দেওয়া দক্ষতা থাকে। যেমন – কেউ দুর্দান্ত ছবি আঁকে, আবার কারোর অঙ্কে জুড়ি মেলা ভার, কেউ খুব সুন্দর কবিতা লেখে, কেউবা খুব ছোট্ট বেলা থেকে হারমনিয়াম বাজিয়ে দারুণ গান গায়। তাই, এমনটা একেবারেই নয় যে, অটিজম্ থাকলে সে পড়াশোনা কিছুই করতে পারবেনা, বা জীবনে তার কিছুই হবেনা; শুধু পড়ার বিষয় যাতে সে সহজে বোঝে তার জন্য পড়ানোর পদ্ধতি সেই মানুষটার প্রয়োজন অনুযায়ী (need based) হতে হবে।
আসলে, যেসব মানুষদের (ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের এবং পূর্ণবয়স্ক মানুষদের) হাবভাব, আচরণ আর পাঁচজনের থেকে আলাদা, অন্যরকম, বেশীরভাগ মানুষের সাথে মেলে না, অর্থাৎ নন-নরম্যাটিভ (non-normative) তাদেরকে অনেকসময়ই বিশেষ কোন নাম দিয়ে দিয়ে দেওয়া হয়, যেন এই নামগুলোই এই মানুষদের পরিচিতি। কিন্তু, কেউ যদি কানে কম শোনে, বা খুঁড়িয়ে হাঁটে – আর তার নামের আগে ‘কালা’ বা ‘খোঁড়া’ বসিয়ে যদি তার নাম ধরে ডাকা হয়, তাহলে যেমন সেই মানুষটার কষ্ট হবে; ঠিক তেমনি, অত্রি বা অত্রির মত মানুষ যার অটিজম্ আছে, তাকে যদি সবসময় ‘অটিস্টিক’, ‘অ্যাবনরমাল’, কিম্বা ‘পাগল’ এইসব নাম দেওয়া হয় তাহলে সেই মানুষটাকে, আর নিজের শিক্ষাকে অপমান করা হয়। বিশ্বের তাবড় মনোবিজ্ঞানীরা বলছেন অটিজম্ কখনই একজন মানুষের পরিচয় হতে পারেনা; তাঁরা আরও বলছেন, যদিও একে অটিজম্ স্পেকট্রাম ডিসঅর্ডার বলা হয়, তবুও এটা কোন রোগ নয়, এটা একটা অবস্থা, বা কন্ডিশন। কোন তাগা, তাবিজ, মাদুলি, লাল-কালো সুতো, এমনকি হোমিওপ্যাথি এইসব কোন কিছুতেই অটিজম্কে কাবু করা যাবেনা। আধুনিক চিকিৎসাপদ্ধতি এখনও পর্যন্ত এবিষয়ে কোন সমাধান দিতে পারেনি। আসলে অটিজম্ – এই অবস্থা সারাজীবনই থাকবে। শুধুমাত্র প্রশিক্ষিত মনোবিদের পরামর্শ এবং বিভিন্ন সুপরিকল্পিত থেরাপির মাধ্যমে অবস্থার উন্নতি সম্ভব। বিদেশে দেখা যায় দিব্যি স্পেকট্রামে থাকা একজন মানুষ উচ্চশিক্ষা করছে, বন্ধুবান্ধব দের সাথে আড্ডা, প্রেম – ভালবাসা সবকিছুই অটিজম্ কে সঙ্গে নিয়ে দিব্যি চলছে, শুধু আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি একটু পালটাতে হবে।
তাহলে, এবার থেকে – রাস্তাঘাটে, ভিড় বাসে – ট্রেনে, শপিং মলে, অনুষ্ঠান বাড়িতে কখনো কোন মানুষকে যদি দেখি অন্যদের থেকে কিছু আলাদা আচরণ করছে, প্রচণ্ড শব্দে বা তীব্র আলোয় অস্থির, অসহিস্নু হয়ে পড়েছে, তাহলে সেই মানুষটাকে অবজ্ঞা না করে, বোঝার চেষ্টা করবো মানুষটার অটিজম্ আছে কিনা, কোন ভাবে তাকে স্বস্তি অনুভব করাতে পারি কিনা। নিচে দুটো লিঙ্ক দিলাম, যদি এই বিষয়ে আরও বিশদে কারোর জানতে ইচ্ছা হয়।