ঘটনা? নাকি দুর্ঘটনা!
“হ্যাঁরে বাবু কত রোগা হয়ে গেছিস রে, খাওয়া-দাওয়া কিছু করিস না, তাই না!”
মা এর কথার রেশ টেনেই বাবা বললো -“এজন্যই তো যেই দেখলাম বাজারে বেশ ভালো ইলিশ, নিয়ে এলাম, হোস্টেলে তো আর ইলিশ জোটে না!”
হ্যাঁ বাবা, মাছ টা কিন্তু বেশ। তা তুমি কি বলছিলে, শুভজিৎ আসবে? বাহ্! কতদিন দেখা হয় না।
“আজ বাজারে হঠাৎ দেখা, ইলিশ কিনছি দেখে প্রায় ছুটে এসে জানতে চাইলো, কাকু, অঙ্কুর আসছে নাকি? আমি ওকে বললাম বিকেলে আসতে বাড়িতে।”
–বাহ্! দারুন মজা হবে, কত্তদিন পর জমিয়ে আড্ডা হবে। আচ্ছা মা আমি একটু ঘুমিয়ে নি, ও এলে আমাকে ডেকে দিও, ট্রেন এ একেবারেই ঘুম হয় নি।
“বাবু ওঠ, দেখ কে এসেছে” – মা এর ডাকে চোখ খুলতে খুলতেই দেখি ঘরে হাজির শুভ!
– আরে! কতদিন পর দেখা, বল কেমন আছিস? হাতে ওটা কি রে?
– কি আবার! তোর পছন্দের সিঙ্গাড়া, কাকিমা এই রাখো। আর একটু চা এনো কিন্তু, জানোই তো তোমার হাতের চা ছাড়া তোমাদের বাড়ি আসাটাই অপূর্ণ।
–হ্যাঁ, তো বল কি খবর তোর? শুনলাম অনেক টিউশন পড়াচ্ছিস?
ওই আর কি, জানিস ই তো পড়াতে আমার খুব ভালো লাগে, তার সাথে চাকরির পরীক্ষা দিচ্ছি আর কি! তা বল তোর কাজকর্ম কেমন চলছে? গবেষণা করছিস তো? তারাদের নিয়ে না তোর গবেষণা? বল না কি করছিস? শুনি শুনি, খুব খুব ইচ্ছে করে শুনতে।
–হ্যাঁ রে, তারাদের নিয়েই।
“কি কি খুঁজছিস তোরা? নতুন তারা?” – খানিকটা উল্লাসিত হয়েই শুভ জিজ্ঞেস করলো!
–না ঠিক নতুন তারা নয়, তবে তাদের মধ্যে কিভাবে বিভিন্ন মৌলিক পদার্থ তৈরি হচ্ছে সেই নিয়ে।
“তাই? কি দারুন! এই শোন না। অত গভীর ভাবে না, একটু সহজ সরল ভাবে বোঝা না কিভাবে হচ্ছে সেসব মৌল তৈরি? আচ্ছা, তোর মনে পড়ে সেই ছোটবেলায় টিউশন থেকে ফেরার পথে রাত হয়ে যেত, আর আমরা সেই ওই পাল পাড়ার অন্ধকার মোড়টাতে দাড়িয়ে তারা দেখতাম, তারামন্ডল চিনতাম- কালপুরুষ, সপ্তর্ষিমন্ডল, আরো কত কি! উফফ! আবার যেন ফিরে গেলাম সেই দিনগুলোতে। আজ তোকে ছাড়ছি না, শুনেই ছাড়বো কিভাবে এসেছে এসব মৌল।” – এক লহমায় যেন চোখের সামনে হাজির হলো ছোটবেলার স্মৃতি গুলো।
আমিও খানিকটা আবেগের স্বরেই বলতে শুরু করলাম, “হ্যাঁ, ভোলা যায় দিনগুলো? সেই থেকেই তো স্বপ্নের শুরু রে। তুই কি জানিস, এই আমি, তুই, আমরা সবাই, চারপাশে সব কিছু – সবকিছুই ওই তারাদের টুকরো? তারাতেই আমাদের জন্ম!”
–অ্যাঁ? আমাদের জন্ম তারাতে? কি বলছিস কি! কিছুই বুঝছি না।
–আহা, শোন শোন। আসছি ধীরে ধীরে। দেখ এটা আমরা তো ছোটবেলা থেকেই জেনে আসি মহাবিশ্বে মোটামুটি প্রায় ১০৫ টি মৌল রয়েছে, কিন্তু কখনো আমরা ভেবে দেখিনি এগুলো এলো কি করে পৃথিবীতে?
–ঠিক তো!
–এসকলই কিন্তু তৈরি হয়েছে মহাবিশ্বে, কিছু, যেমন হাইড্রোজেন, হিলিয়াম, লিথিয়াম এই তিনটি তৈরি হয়েছিল…
“কি শুভজিত? অনেক দিন পরে এলে বলো! তোমার বন্ধু তো সে কি খুশি তুমি আসবে বলে। এই তোমরা কিছু কথা বলছিলে না, মাঝে থামালাম, ঠিক আছে আমি একটু হেঁটে আসি।” বাবা কে প্রায় পথ আটকেই শুভ বলে উঠলো – “আরে না না কাকু তুমিও এসো না আমাদের আড্ডায়, অঙ্কুর গল্প করছিল, তারাদের কথা, ওর গবেষণার কথা এসব নিয়েই!”
“কি? তারা নিয়ে? কতদিন যে ভেবেছিলাম তোর কাছে শুনবো এসব, বাবু। না আজ আর হাঁটতে যাবো না তাহলে, গল্প শুনি তারাদের।”
–হ্যাঁ, বাবা বসো। যেটা বলছিলাম। আমাদের এই মহাবিশ্বের জন্ম কিভাবে হয়েছে সেটা নিয়ে বিজ্ঞানীদের মধ্যে অনেক মত বিভেদ ছিল বিংশ শতাব্দীর শুরুতেও। এমনি এক তত্ত্ব মহাবিস্ফোরণ তত্ত্ব!
“বিগ ব্যাং থিওরি! তাই না! হ্যাঁ আমি শুনেছি” – বাবার চোখে যেন তখন ঠিক পরীক্ষায় কমন আসা প্রশ্ন দেখে আনন্দিত হওয়ার অনুভূতি!
“হ্যাঁ কাকু, তুমি ঠিকই বলছো।” শুভ বলে উঠল।
আমি আবার বলতে থাকলাম-“হ্যাঁ, তো সেই বিগ ব্যাং থেকেই যে মহাবিশ্বের উৎপত্তি, সেটার স্বপক্ষে অনেক পরীক্ষাতেই জোরালো প্রমাণ পাওয়া গেছে। সেই ঘটনা ঘটেছিল আজ থেকে ১৩.৮ বিলিয়ান বছর আগে”- ।
“মিলিয়ান মানে ১ এর পিঠে ৬ টা শূন্য, তাহলে বিলিয়ন ১ এর পিঠে ৯ টা শূন্য। বলিস কি এত্তো বছর আগে!” – বাবার চোখে তখন ঘোর বিস্ময়!
–হ্যাঁ বাবা ১৩৮০ কোটি বছর আগে জন্ম এই বিশ্বের। একটি বিন্দু তে মহাবিশ্বের সমস্ত ভর ছিল কেন্দ্রীভূত। উষ্ণতা ও ঘনত্ব ছিল অকল্পনীয়। প্রবল সেই বিস্ফোরণের সাথে সাথেই সব দিকে সমান ভাবে সম্প্রসারণ শুরু হলো মহাবিশ্বের। জন্মের সাথে সাথেই কমতে শুরু করলো বিশ্বের উষ্ণতা ও ঘনত্ব। প্রথম কনার সৃষ্টি হল – প্রোটন, নিউট্রন, ইলেকট্রন। তার সাথে ফোটন তথা আলোক কণাও মুক্তি পেলো। কয়েক মিনিটের মধ্যেই একটি প্রোটন ও একটি নিউট্রন মিলে তৈরি হলো প্রথম নিউক্লিয়াস।
“হাইড্রোজেন এর নিউক্লিয়াস। তাইতো?” শুভ আমাকে থামিয়ে বললো।
–হ্যাঁ। তখনো কিন্তু উষ্ণতা বেশ অনেকটাই, তাই তখনো ইলেকট্রন যোগ দেয় নি সেই পরিবারে, অর্থাৎ পরমাণু তৈরি হয় নি। তবে আজ মহাবিশ্বে যতো হাইড্রোজেন সব কিন্তু তৈরি হয়েছে ওই বিগ ব্যাং এর সময়েই!
“মানে আমাদের পৃথিবীতে যে জল আছে তার হাইড্রোজেনও কি ওই সময়ে তৈরি? বলিস কি!” – বাবা যেন আরও বিস্মিত!
হ্যাঁ বাবা, এরপর দুটো হাইড্রোজেন নিউক্লিয়াস মিলে তৈরি করলো হিলিয়াম আয়ণ। আবার সেই হিলিয়াম আয়ণ…
“নে নে চা এসে গেছে, সাথে সিঙ্গাড়া। তুমিও একটা সিঙ্গাড়া খাও, শুভজিৎ এনেছে” – ইয়া বড় একটা ট্রে তে চা আর সিঙ্গাড়া নিয়ে মা হাজির।
“যতই থাক সুগার, সিঙ্গারার লোভ কি সামলানো যায়? কি বলিস শুভ? হাহাহা…”
বাবার সিঙ্গারা প্রীতি আমার অজানা না, তাই খানিকটা বাধ্য হয়েই আমি বললাম, “একটা খেলে কিছু হবে না, খাও তো বাবা।”
“হ্যাঁ রে, রান্না ঘর থেকে আমিও শুনছিলাম তোদের কথা, সব না বুঝলেও আমার কিন্তু খুব সুন্দর লাগছিল শুনতে। বল বল তুই বল বাবু, আমিও শুনি।” – মা এর চোখই বলছিল মা কতটা উৎসুক তারাদের গল্পে!
–তুমি শুনেছ? তাহলে আমি আর আগের থেকে বলছি না, মা। তো যেটা বলেছিলাম, এরপর হলো কি একটা হিলিয়াম আর একটা হাইড্রোজেন যুক্ত হয় তৈরি হলো মহাবিশ্বের তৃতীয় মৌল – লিথিয়াম, তবে তার পরিমাণ খুব কম। ৭৫ টা হাইড্রোজেন নিউক্লিয়াস পিছু তৈরি হলো প্রায় ২৪ টা করে হিলিয়াম। আর প্রতি এক লক্ষ কোটি হাইড্রোজেন পিছু মাত্র একটি লিথিয়াম! এদিকে মহাবিশ্ব আরো প্রসারিত হয়ে গেছে ততক্ষনে, উষ্ণতা আরও কমে গেছে। এযাবৎ তৈরি হওয়া মৌলগুলি দিয়ে, বিশেষত হাইড্রোজেন নিয়ে তৈরি হলো বিশ্বের প্রথম প্রজন্মের তারা গুলি। এই যে এই অব্দি যে মৌল গুলি তৈরি হলো বিগ ব্যাং এর তাৎক্ষণিক পরে, সেই প্রক্রিয়াকে আমরা বলি বিগ ব্যাং নিউক্লীয় সিনথেসিস। এরপর বাকি সব মৌল যা এখন আমরা দেখছি এসবের জন্ম কিন্তু হয়েছে ওই তারা গুলোতেই, আর তাই এই যে তারাতে নতুন মৌলের রান্না, এটাকে বলে স্টেলার নিউক্লীয় সিনথেসিস।
“তাহলে তারাগুলোই মৌলের রান্নাঘর, বাবু?”
– হ্যাঁ মা, ওই লিথিয়াম এর পর থেকে যা যা মৌল এসেছে সব এর জন্ম ওই তারা গুলোতেই। তারাদের জীবনকালের নানা পর্যায়ে তৈরি হয়েছে ওগুলি, আবার তারাদের মৃত্যুর পর সেগুলো ছড়িয়ে পড়েছে মহা বিশ্বে। তার থেকেই তৈরি হয়েছে আমাদের চারপাশের সবকিছু, এমন কি আমি, মা তুমি, আমরা সবাই! তাই তো প্রথমে বলছিলাম না আমরা সবাই তারাদের অংশ! মজার ব্যাপার সব মৌল কিন্তু একইভাবে তৈরি হয়নি, আর এই নিয়ে গবেষণা করতে গিয়েই বিংশ শতকের প্রথম অর্ধে বিজ্ঞানীরা সম্মুখীন হলেন এক রহস্যের।
“রহস্য? কিসের রহস্য!”- এবার শুভর মুখে যেন খানিকটা সন্দেহের ভাব!
বলছি, তার আগে আরেকটা কথা বলত, শুভ।আমাদের, মানে পৃথিবীতে প্রাণের, জন্য অপরিহার্য উপাদান গুলো কি কি?
-“কি আবার, জল, অক্সিজেন!”
–তারও আগে আরেকটা মৌল প্রয়োজন।
-“কার্বন?”
–একদম, ঠিক বলেছ বাবা।
“কি রকম ভাবে?” – বেশ কিছুক্ষন চুপচাপ শোনার পর খানিকটা ব্যাকুলতার সুরে মা জিজ্ঞেস করলো!
মা, আমার থেকে বাবাই ভালো বলতে পারবে এটা, বাবা তুমিই বলো না একটু।
“হ্যাঁ, শোনো তবে।” – বাবা বলতে শুরু করলো – “এটা তো আমরা জানিই যে একাধিক মৌল নিয়ে তৈরি হয় যৌগ। পৃথিবীর সমস্ত প্রাণীকূলই তেমন অজস্র যৌগ নিয়ে গঠিত। এগুলিকে আমরা জৈব যৌগ বলে থাকি। মূলত চার প্রকারের জৈব যৌগ থাকে সমস্ত জীব এ – কার্বোহাইড্রেট, লিপিড, প্রোটিন এবং নিউক্লিক অ্যাসিড। কার্বোহাইড্রেট একদিকে যেমন শক্তি উৎপাদন করে তেমনি আবার শক্তি সঞ্চয় করে রেখে শারীরিক গঠন প্রক্রিয়ায় সাহায্য করে। লিপিড ও কিন্তু শক্তি সঞ্চয়ে সাহায্য করে, তাছাড়া আমাদের দৈহিক কোষগুলির কোষ পর্দা তৈরিতে এর মুখ্য ভূমিকা। প্রোটিনের কাজ তো তোমরা জানোই। আর নিউক্লিক অ্যাসিড তৈরি করে ডিএনএ, আরএনএ – এক প্রজন্ম থেকে পরের প্রজন্মে সমস্ত শরীরবৃত্তিয় বার্তা বহন করে এরাই। মজার ব্যাপার হলো এই সমস্ত যৌগগুলিরই অপরিহার্য একটি উপাদান কার্বন। তাই কার্বন না থাকলে এই যৌগগুলিও থাকতো না, আর তার ফলে এখন আমরা প্রাণ বলতে যা বুঝি সেটাও এভাবে থাকতো না।”
-“বাহ্ কাকু, সেই ক্লাস ৯ এ তোমার পড়ানোগুলো মনে পড়ে গেলো।“
–হ্যাঁ রে শুভ, উফ্! সেই দিনগুলো। যাক গে, সে সব পুরনো দিনের কথা অন্য কখনো হবে।
আমি যেটা বলছিলাম,এই কার্বন এলো কি করে পৃথিবীতে? বিজ্ঞানীরা বুঝলেন যে মহাবিস্ফোরণ এ তৈরি হওয়া দুটো আলফা কণা মিলিত হয়ে তৈরি হতে পারে বেরিলিয়াম নিউক্লিয়াস।
-“আলফা? মানে তুই বলছিস হিলিয়াম পরমাণু এর নিউক্লিয়াস তাইতো?”
–একদম আগেই বলেছি ওই উচ্চ তাপমাত্রায়…
“যাহ, এতো বৃষ্টি নেমে গেলো রে, সাইকেলটা ভিজবে, তুলে আসি” – ছুট লাগলো শুভ, সাইকেলের প্রতি ওর সেই স্নেহটা এখনো দেখছি এক ই রকম আছে!
“দেখ দেখ পুকুরটাতে কত ব্যাঙাচি! কি অদ্ভুত এই প্রাণের স্পন্দন তাইনা…!” – শুভর কথা শুনেই চোখ গেলো জানলা দিয়ে বাইরে বাড়ির ঠিক পাশের পুকুরটার দিকে!
-“নে তুই আবার শুরু কর যেটা বলছিলিস।”
হুম্ যেটা বলছিলাম, ওই উচ্চ তাপমাত্রায় পরমাণু আয়নিত হয় যায়, পড়ে থাকে শুধু নিউক্লিয়াস। ১৯৫০ এর দশকে বিজ্ঞানী সল্পিটার তার গবেষণা পত্রে অনুমান করলেন যে কার্বন তৈরি হয় দুই ধাপে, প্রথমে দুটি আলফা কণা মিলে বেরিলিয়াম, আর তারপর সেই বেরিলিয়াম এর সাথে আরো একটি আলফা কণা মিলে কার্বন। তা, বেরিলিয়াম তো তৈরি হলো, কিন্তু মুশকিলটা এলো এখানেই। বিজ্ঞানীরা পরীক্ষা করে দেখলেন এই বেরিলিয়াম এর জীবন কাল ভীষণ ভীষণ কম। মাত্র ১০-১৬ সেকেন্ড! অর্থাৎ বলা যেতে পারে তৈরির সঙ্গে সঙ্গেই বেরিলিয়াম ভেঙে গিয়ে আবার দুটি আলফা কণা তৈরি করে। কিন্তু ওদিকে যদি বেরিলিয়াম নিউক্লিয়াস আলফা কনার সাথে যুক্ত হতে পারতো তবেই তৈরি হতো কার্বন পরমাণু, আর সেই সুযোগ কিন্তু দিল না বেরিলিয়াম, কারণ পরের আলফা কনার সাথে যুক্ত হবার আগেই উনি আবার নিজেই ভেঙে গেলেন যে!
-“হুম্, রহস্য! তাহলে? কিন্তু কার্বন তো আছেই মহাবিশ্বে, তাহলে তৈরি হলো কি করে!”
–হ্যাঁ আছেই তো, এমনকি মহাবিশ্বের সব থেকে বেশি পরিমাণে যে মৌলগুলি আছে তার মধ্যে কার্বন হলো চার নম্বরে! ১৯৫৩ সালে বিজ্ঞানী হয়েল এক অতি আশ্চর্য গবেষণা পত্র প্রকাশ করলেন আমেরিকান ফিজিক্যাল সোসাইটির এক বিখ্যাত পত্রিকায়, তাতে তিনি যে অনুমান দিলেন সেটিকে পদার্থবিদ্যার গবেষণা সংক্রান্ত অনুমানগুলির মধ্যে অন্যতম বলে ধরা হয়। উনি বললেন কার্বন পরমাণুর এমন একটি উদ্দীপ্ত শক্তি স্তর আছে যার শক্তির পরিমাণ ৭.৬৮ মেগা ইলেকট্রন ভোল্ট। যেমন জুল শক্তির একক তেমনি মেগা ইলেকট্রন ভোল্টও হলো শক্তির আরেকটি একক।
এই দেখ, এই যে মই আঁকলাম, এর যেমন এক একটি ধাপ রয়েছে প্রতিটি পরমাণুর এরকম শক্তি স্তর রয়েছে, যা ক্রমবর্ধমান। মইটির প্রতিটি ধাপ কে এক একটা শক্তি স্তর হিসেবে ভাবা যেতে পারে। একদম নিচের যে ধাপ, সেটিকে বলে ভূমি স্তর। এর ওপরের এক একটি ধাপ হলো এক একটি শক্তি স্তর।
ও হ্যাঁ, যেটা বলছিলাম, আর ওই বেরিলিয়াম নিউক্লিয়াস যদি ভাঙনের আগেই একটি আলফা কনার সাথে ওই শক্তি সহযোগে নিউক্লীয় বিক্রিয়া করতে পারে, তাহলেই পর্যাপ্ত পরিমাণে তৈরি হওয়া সম্ভব কার্বন পরমাণুর। ঠিক ৪ বছর পর আরো এক দল বিজ্ঞানী পরীক্ষা করে দেখলেন, হ্যাঁ তাই তো, কার্বন পরমাণুর সত্যিই একটু উদ্দীপ্ত শক্তি স্তর রয়েছে যার শক্তির পরিমাণ ওই ৭.৬৮ মেগা ইলেকট্রন ভোল্ট এর আশেপাশেই। আবারও সেই আমেরিকান ফিজিক্যাল সোসাইটির পত্রিকায় প্রকাশিত হল সেই গবেষণা। প্রমাণিত হলো নিউক্লীয় রেসনেন্স বিক্রিয়ার তত্ত্ব। বিজ্ঞানী হয়েলের অনুমান আর অনুমান থাকলো না, পরীক্ষালব্ধ সত্যি বলে প্রতিষ্ঠা পেলো। উন্মোচিত হলো অনেক বছরের রহস্য।
“এ যেন রূপকথা, বাবু!!” – মা এর চোখে তখন ঘোর বিস্ময়! সাথে বাবাও যোগ দিলো – “তার মানে ওই একটা শক্তি স্তর ই সব রহস্যের সমাধান করলো?”
“আচ্ছা, রেসনেন্স বা অনুনাদ বলতে ওই ব্রিজের কথা মনে পড়লো ছোট বেলায় পড়া, তাই না অঙ্কুর?”
–আরে দাড়াও দাড়াও, এক করে আসছি তোমাদের সব প্রশ্নে।না মা, রূপকথা না, এটাই বাস্তব। হ্যাঁ বাবা, শুধু একবার ভাবো ওই একটি শক্তিস্তর ছিল বলেই আজ আমরা আছি, মহাবিশ্বে প্রাণ আছে! এটাকে ঘটনা বলবে নাকি দুর্ঘটনা! ওই দুর্ঘটনা না ঘটলে আজ হয় তো প্রাণ থাকলেও থাকতো একেবারে আলাদা রূপে। আর, হ্যাঁ রে শুভ, ছোট বেলায় পড়েছিলাম না, ব্রিজের ওপর দিয়ে সৈন্য দের মার্চ করতে নেই? কি হয় যে, যদি সৈন্যরা মার্চ করে তাহলে এটা হতে পারে যে সৈন্য দের মার্চ করার যে স্পন্দন যাকে কম্পাঙ্ক বলি আমরা, সেটা মিলে যেতে পরে ব্রিজের কম্পাঙ্কের সাথে, ফলে ব্রিজ ভয়নক ভাবে দুলতে থাকবে! ঠিক এখানেও দেখ যেই কিনা ওই বেরিলিয়াম আর আলফা কনার বিক্রিয়ার শক্তি, কার্বনের ওই শক্তি স্তরের সমান হলো, অমনি প্রচুর পরিমাণে তৈরি হয় গেলো কার্বন। তাই একটাকেও আমরা রেসনেন্স বিক্রিয়াই বলি।কি হলো তোমরা সব চুপ কেন মা, বাবা?
“কিছু না। ভাবছি কি অদ্ভুত এই সৃষ্টির গল্প তাই না? এ কি ঘটনা, নাকি স্রেফ এক দুর্ঘটনা? এই দুর্ঘটনা না ঘটলে আমাদের ই অস্তিত্ব থাকতো না তাই না?” – কেমন যেন অস্পষ্ট আর চিন্তামগ্ন গলায় বাবা বললো।
“অঙ্কুর তোর গবেষণাও কি এই কার্বন নিয়ে?”
না রে, এটা নিয়ে না। কিন্তু কিভাবে তৈরি হলো আরো সব মৌল আমি সেসব নিয়েই কাজ করছি। কিন্তু আমি সব সময় ই মনে করি কার্বন তৈরির এই রহস্য সমাধান না হলে আমরা এগোতেই পারতাম না বাকি গবেষণাতে। তাই এটা বড্ড স্পেশাল, আর তাই এতো কিছু বললাম। আমিই বকে গেলাম এতক্ষণ, এবার তোর কথা শুনি।
“উফফ, কি যে অনুভূতি হচ্ছে এই সব গল্প শুনে, কিভাবে বোঝাব! আরও শুনতে পারলে ভালো লাগতো কিন্তু আজ আর না রে, বৃষ্টি ও কমে গেছে, মা চিন্তা করবে ৯ টা পেরিয়ে গেছে আজ আসি, আবার আসবো একদিন ” – বলেই উঠে পরলো শুভ।
“কাকু কাকিমা আমি আসছি তবে, আর হ্যাঁ কাকিমা,বরাবরের মত আজকের চা টাও কিন্তু ..!”
► লেখা ভাল লাগলে অবশ্যই লাইক করুন, কমেন্ট করুন, আর সকলের সাথে শেয়ার করে সকলকে পড়ার সুযোগ করে দিন।
► এলেবেলেকে ফলো করুন।
খুব মজাদার করে বিজ্ঞানকে তুলে ধরা হয়েছে লেখাটার ভিতর দিয়ে। আশা করা যায় সকলেই রচনাটি পড়ে উপভোগ করবে। লেখককে সাধুবাদ জানাচ্ছি।🙏😊🙏
উফফ!! এ যেন পুরো রূপকথা!!
অসাধারণ লেখা,খুব সুন্দর।।