ও যে মানব কোষ দিয়ে তৈরি সে দেশ, ব্যাক্টেরিয়া দিয়ে ঘেরা (প্রথম পর্ব): ত্বকের গহন অরণ্যে
শীতের সকাল, ঠান্ডায় কাঁপতে কাঁপতে হলেও আজ অর্ণবকে যেতেই হবে গ্রামের স্কুলে। গ্রামের দরিদ্র বাচ্চাদের পড়ানো, তাদের কুসংস্কার মুক্ত করে বিজ্ঞাননির্ভর করে তোলা, সমাজের পথে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া, এইসব তো তার অন্যতম লক্ষ্য জীবনের। কিন্তু গবেষণার জন্য তাকে চলে যেতে হয়েছিল সুদূর কানাডায়। তারপর নিজের দেশে ফিরে সটান চলে আসে তার গ্রামের বাড়িতে জীবনের অন্যতম লক্ষ্য পূরন করতে। তাই এমন একটা সুযোগ কোন ভাবেই হাত ছাড়া করতে চাইল না অর্ণব।
জলের বোতল আর টিফিন বক্সটা একটা ব্যাগে পুরে রওনা দিলো স্কুলে। স্কুলে ঢুকতেই পুরনো সব স্মৃতি ভেসে আসতে লাগল অর্ণবের। প্রায় ত্রিশ বছর আগে এই অবৈতনিক স্কুলটাই ছিল তার দ্বিতীয় বাড়ি। এখনও সেরকম কিছুই পাল্টায়নি, তবে রঙ করা হয়েছে স্কুল বাড়িটাকে।
একজন কর্মচারী এসে তাকে নিয়ে গেলেন শ্রেণীকক্ষে। কিলবিল করছে বাচ্চা। সবারই বয়স ১৩ থেকে ১৫ বছর হবে। অর্ণবকে ঢুকতে দেখেই তারা সবাই বেশ থমকে গেল।
“আমি অর্ণব বসু। আমিও এই স্কুলেই পড়তাম তোমাদের মতন। ওই যে থার্ড বেঞ্চের কর্নার, ওখানে আমি বসতাম। তবে তোমাদের মত অত বুদ্ধিমান ছিলাম না আমি। আজ তোমাদের খুব মজার একটা জিনিস শেখাবো। আর হ্যাঁ, ভুল হলে ধরিয়ে দিও কিন্তু। আচ্ছা তোমরা একটা হাত আর একটা হাতের উপর রাখো তো। এবার পায়ের উপর হাতটা রাখো। আমরা কি স্পর্শ করছি?”
“হাত আর পা স্যার”।
উঁহু। আমরা ত্বক স্পর্শ করছি। ত্বক বা চামড়া এমন একটি অঙ্গ যা আমাদের দেহকে বাইরে থেকে ঢেকে রাখে এবং এটি আমাদের দেহের বৃহত্তম অঙ্গ। একটি মূর্তি বানানোর জন্য যেমন খড় বা বিচুলির তৈরি কাঠামোর প্রয়োজন হয়, তেমনি আমাদের দেহের কাঠামো হলো অস্থি। এই কাঠামোর ভিতরে থাকে আমাদের বিভিন্ন অঙ্গ এবং সেই সব অঙ্গ ও পেশিকে বাইরের যে কোনো আঘাত থেকে এবং ভাইরাস ও ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণ থেকে বর্মের মতো রক্ষা করে আমাদের ত্বক।
ত্বক হল মানব দেহের বৃহত্তম অঙ্গ
ত্বককে দুটি স্তরে ভাগ করা হয়।
-
বাইরের স্তর বা বহিঃস্ত্বক বা এপিডারমিস
-
ভিতরের স্তর বা অন্তঃস্ত্বক বা ডারমিস
এপিডারমিস: এপিডারমিস কথাটি এসেছে গ্রিক শব্দ “এপি” থেকে, যার অর্থ উপরিভাগ। এই স্তরটি জল-অভেদ্য এবং তিন প্রকার কোষ নিয়ে গঠিত হয়। মার্কেল কোষ (স্পর্শ গ্রাহক), কেরাটিনোসাইট যার মধ্যে থাকে মেলানোসাইট (রঞ্জক উৎপাদক কোষ) এবং ল্যাঙ্গারহ্যানস্ কোষ (অনাক্রম্য কোষ)। মেলানোসাইট কোষ মেলানিন তৈরি করে যা আমাদের ত্বক বা চামড়ার রঙের জন্য দায়ী। এই স্তরের কোষগুলি প্রতি ১৫ থেকে ৩০ দিন অন্তর ঝরে পড়ে যায় এবং পুনরায় নতুন কোষ দ্বারা পূর্ণ হয়।
এপিডারমিস আবার পাঁচটি স্তরে বিভক্ত। বাইরে থেকে ভেতরের দিকে যথাক্রমে—
-
স্ট্র্যাটাম কর্নিয়াম: আমরা বাইরে থেকে ত্বকের এই স্তরটিকেই দেখি। এখানকার কোষগুলি চ্যাপ্টা এবং আঁশ প্রকৃতির হয়। এদের স্কোয়ামাস কোষ বলা হয়। কোষগুলি মৃত প্রকৃতির হয়। এই স্তরে অনেক বেশী কঠিন কেরাটিন থাকায় তা বাইরের তাপ এবং ঘর্ষণজনিত আঘাত থেকে আমাদের রক্ষা করে। এছাড়া এখানের কোষগুলি একটা স্তরের উপর আরেকটা স্তরে সাজানো থাকে এবং এই স্তর থেকেই চুলের উৎপত্তি হয়।
-
স্ট্র্যাটাম লুসিডাম: এই স্তরটি বেশ কিছু চ্যাপ্টা, মৃতকোষ দিয়ে তৈরি হয় এবং পুরু বা মোটা স্তর তৈরি করে। ত্বকের অপেক্ষাকৃত পুরু জায়গাতে যেমন— হাতের চেটো, পায়ের তলায় এরা অবস্থান করে।
-
স্ট্র্যাটাম গ্রানুলোসাম: এই স্তরটি মূলত ৩–৪ টি স্তর নিয়ে গঠিত হয়। এখানে কেরাটিন প্রোটিন তৈরি হয় যা একটি বর্ণহীন প্রোটিন এবং ত্বকের দৃঢ়তার জন্য দায়ী।
-
স্ট্র্যাটাম স্পাইনোসাম: এই স্তরেও কেরাটিন প্রোটিন তৈরি হয় এবং কোষগুলি ক্রমশ গ্রানুলোসাম স্তরে চলে আসে। রক্তপ্রবাহ কম হওয়ার কারণে কোষগুলি মরে যায় এবং ঠেলে উপরের দিকে উঠে আসে। ফলে তাদের কোষ মধ্যস্থ তরল বা সাইটোপ্লাজম বেরিয়ে আসে এবং কোষের মধ্যে কেরাটিন প্রোটিন প্রবেশ করতে থাকে। এই পদ্ধতিকে বলা হয় ‘কেরাটিনাইজেশন’। কেরাটিন প্রোটিন নখ, চুল ইত্যাদি তৈরিতে সাহায্য করে।
-
স্ট্র্যাটাম বেসাল বা স্ট্র্যাটাম জার্মিনেটিভাম: এটি এপিডারমিসের সবচেয়ে ভিতরের স্তর। ত্বকের একদম উপরের স্তর থেকে ক্রমাগত মৃত কোষগুলি ঝরে যায় এবং বেসাল স্তরের কোষগুলি বিভাজিত হয়ে সেই শূন্যস্থান পূরণ করে। এই স্তরে থাকা মেলানোসাইট কোষ মেলানিন তৈরি করে যা আমাদের ত্বককে সূর্যের অতিবেগুনি রশ্মি থেকে সুরক্ষিত রাখে। মেলানিন ত্বকে কতটা তৈরি হবে তা জিন দ্বারা নির্ধারিত হয়। এই স্তরে প্রচুর রক্তবাহ থাকে যা ত্বককে পুষ্টি জোগায়। এছাড়া এই স্তর গরমের সময় দেহ থেকে যেমন তাপ বের করতে সাহায্য করে, তেমনি শীতের সময় সংকুচিত হয়ে দেহকে তাপ ধরে রাখতেও সাহায্য করে।
কোনো সময় কেটে গেলে যদি এই স্তর আঘাত প্রাপ্ত হয়, তবেই রক্তপাত হয়। এছাড়া এখানে ডেনড্রাইটিক, ল্যাঙ্গারহ্যানস্ কোষ থাকে যা ভাইরাস বা ব্যাক্টেরিয়ার আক্রমণ থেকে আমাদের রক্ষা করে।
স্ট্র্যাটাম বেসাল স্তরেই থাকে রক্তবাহ, যা ত্বককে পুষ্টি জোগায়।
ডারমিস: এপিডারমিসের পরের স্তরকে বলে ডারমিস। এই স্তরে প্রচুর ভাঁজ বা প্যাপিলা দেখা যায়, যা পরোক্ষভাবে ফিঙ্গারপ্রিন্ট তৈরির জন্য দায়ী। এই স্তরে ফ্যাট বা চর্বির সাথে থাকে ইলাস্টিন ফাইবার ও কোলাজেন, যা ত্বককে নমনীয় ও স্থিতিস্থাপক করে। যেমন— টেনে ধরলে তার প্রসারণ হওয়া। তবে বয়স বাড়ার সাথে সাথে এই নমনীয়তা নষ্ট হয়ে যায় এবং তার সাথে ত্বকের নীচে থাকা ফ্যাট (সাবকিউটেনিয়াস ফ্যাট) ও নষ্ট হয়ে যায়। যার ফলে ত্বক কুঁচকে যায়।
বয়স বাড়ার সাথে সাথে ত্বকের নীচে থাকা ফ্যাট নষ্ট হয়ে যাওয়ার জন্য ত্বক কুঁচকে যায়।
সূর্যালোকের উপস্থিতিতে ত্বকের মডিফাইড কোলেস্টেরল ভিটামিন–ডি সংশ্লেষ করে যা ক্যালশিয়াম শোষণ করে আমাদের হাড়কে মজবুত রাখে। ওই জন্য বাচ্চাদের ভিটামিন–ডি যুক্ত তেল মাখিয়ে রোদে রাখা হয়। ডারমিস স্তরে প্যাসিনিয়ান কণিকা (যা এক ধরনের স্নায়ু বা গ্রাহক রূপে কাজ করে) থাকে, যারা উষ্ণতার হেরফের, যন্ত্রণা, চাপ ইত্যাদি অনুভব করে মস্তিষ্কে প্রেরণ করে। ফলে আমরা সতর্ক থাকতে পারি। এছাড়া অ্যারেকটর পিলাই পেশীর সংকোচনের জন্য আমাদের লোম খাড়া হয়ে যায়।
“আচ্ছা বলতো চুল বা নখ কাটলে আমরা ব্যথা পাই না কেন?”
আমাদের এই স্তরেই থাকে হেয়ার ফলিকল। সমগ্র শরীরেই তা ছড়িয়ে থাকে। তবে মাথায় সবথেকে বেশি থাকে এবং হাতের চেটো, পায়ের তলা ও ঠোঁটে থাকে না। প্রতিটি হেয়ার ফলিকলের একেবারে নিচের দিকের কোষগুলি ক্রমাগত বিভাজিত হয় এবং ঠেলে উপরের দিকে উঠে আসে। কেরাটিনাইজেশন প্রক্রিয়ায় কেরাটিন জমে কোষগুলি মারা যায়। ফলে তাতে কোনো স্নায়ু বা গ্রাহকও থাকে না। তার জন্য চুল বা নখ কাটলে আমরা ব্যথা পাই না।
“হাইপোহাইড্রোটিক এক্টোডার্মাল ডিস্প্লাসিয়া” রোগে ঘাম নিঃসরণ প্রায় হয়না বললেই চলে
আমাদের সারা ত্বকে প্রায় ৩৭ লক্ষেরও বেশি ঘর্মগ্রন্থি থাকে। যা ঘাম নিঃসরণ এর মাধ্যমে দেহতাপকে বের করে দেহকে ঠান্ডা রাখে। ঘামের মাধ্যমে নানা বর্জ্য পদার্থও দেহ থেকে নির্গত হয়ে যায়।
“হাইপোহাইড্রোটিক এক্টোডার্মাল ডিস্প্লাসিয়া” নামে একটি জিনগত রোগে দেহে ঘর্মগ্রন্থির সংখ্যা এতটাই কম থাকে যে ঘাম নিঃসরণ প্রায় হয়না বললেই চলে।
কেন অনেকের ত্বক তৈলাক্ত বা শুষ্ক হয়?
আমাদের ত্বকে হেয়ার ফলিকলের গোড়ায় সিবেসিয়াস নামক একটি গ্রন্থি থাকে যা থেকে একটি তৈলাক্ত পদার্থ ক্ষরিত হয়। একে সিবাম বলে। সিবাম ট্রাইগ্লিসারাইড, স্যাপিয়েনিক অ্যাসিড, স্কোয়ালিন এবং ফ্যাটি অ্যাসিডের এস্টারের সমন্বয়ে তৈরি হয়।
“স্কোয়ালিন” সারা দেহের মধ্যে শুধুমাএ সিবামেই পাওয়া যায়।
সিবেসিয়াস গ্রন্থি সবচেয়ে বেশি থাকে আমাদের মুখে এবং মাথায়। এছাড়া চোখের জলের মধ্যে মেইবোমিয়ান বা টারসাল গ্রন্থি নিঃসৃত সিবাম থাকে।
অনেকের ত্বকে এই সিবেসিয়াস গ্রন্থি বেশি বা কম থাকে যা সম্পূর্ণ জিনগতভাবে নিয়ন্ত্রিত হয়। এর ফলে অনেকের ত্বক তৈলাক্ত বা শুষ্ক হয়।
ত্বকের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা:
আমাদের ত্বকে প্রায় এক হাজারেরও বেশি অণুজীব বা মাইক্রোঅরগানিজম থাকে। এরা প্রধানত দুই ধরনের হয়।
-
যারা সব সময় দেহের নির্দিষ্ট অংশে থাকে এবং কোনভাবে এদের সংখ্যা কমে গেলে তারা আবার বংশবৃদ্ধি করে নিজেদের সংখ্যাকে সঠিক করে। এদের বলা হয় ‘স্থায়ী অণুজীব’।
-
যাদের কিছু সময়ের জন্য ত্বকে দেখতে পাওয়া যায়, এরা সাধারণত কোনো রোগ সৃষ্টি করে না। কিন্তু স্থায়ী অণুজীবরা কোনভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হলে এরা বংশবৃদ্ধি করে রোগ সৃষ্টি করে। এদের ‘অস্থায়ী অণুজীব’ বলে।
ত্বকের বিভিন্ন অংশে বিভিন্ন ব্যাক্টেরিয়া বসবাস করে। যেমন-
আমাদের মুখে বেশি থাকে প্রোপিওনিব্যাক্টেরিয়া, করিনিব্যাক্টেরিয়া এবং আর্কিব্যাক্টেরিয়া।
হাতের চেটো ও বাহুতে বেশি থাকে প্রোটিওব্যাক্টেরিয়া, স্ট্যাফাইলোকক্কাস, ব্যাক্টেরিওয়েডস্।
পিঠে থাকে প্রোপিওনিব্যাক্টেরিয়া।
হাঁটু এবং পায়ের তলায় থাকে স্ট্যাফাইলোকক্কাস।
আঙ্গুলের ফাঁকে থাকে সায়ানোব্যাক্টেরিয়া, স্ট্যাফাইলোকাক্কাস, মাইক্রোকক্কাস।
নাভিতে থাকে করিনিব্যাক্টেরিয়া।
এইসব ব্যাক্টেরিয়ার সঠিক মাত্রা আমাদের দেহকে অন্যান্য ক্ষতিকারক ব্যাক্টেরিয়ার সংক্রমণ থেকে রক্ষা করে।
“কি সবাই বুঝলে তো?? এই যে চামড়া বা ত্বককে আমরা দেহের উপর থেকে দেখি, তার গভীরে লুকিয়ে থাকে এত রহস্য”।
“কিন্তু স্যার জানো গ্রামে মোড়ল কাকার না কি একটা হয়েছিল, চামড়া খসে খসে পড়ছিল, সে কী ভয়াবহ দৃশ্য!! কেউ কাকার কাছেও যেতনা, ঘরে আটকে রেখে দিত। মা বলেছিল কাকার উপর নাকি অপদেবতা ভর করেছে। কিন্তু আমি বিশ্বাস করিনি। শেষে বিনা চিকিৎসায় কাকা মারা গেল”।
“জানি রে। আজও এরকম অজপাড়াগ্রামে অনেক রোগকে মানুষ অপদেবতার কারসাজি ভেবে নেয়। আর বিনা চিকিৎসায় রোগীকে মরতে হয়। তবে ভাবিস না। আমি তোদের আস্তে আস্তে সব শিখিয়ে দেব। ত্বকের সম্ভাব্য কি কি রকমের রোগ হতে পারে এবং তার কারণ, লক্ষণ, প্রতিকার কি- সব বুঝিয়ে দেব, যাতে কোনো রোগীকে কুসংস্কার ও অপসংস্কৃতির বেড়াজালে আবদ্ধ হয়ে অকালে মরতে না হয়। তাই আমরা যা শিখলাম তা বাড়ি গিয়ে সবাইকে বোঝাতে হবে। শুধু নিজে শিক্ষিত হলেই হবে না, আশেপাশের সবাইকে শিক্ষিত করে তুলতে হবে। তবেই তো এগোবে দেশ।”
বাতানুকূল হলঘরে দাঁড়িয়ে হাজার হাজার মানুষের সামনে লেকচার দেওয়ার থেকে আজ গ্রামের এই কয়েকজন গরিব বাচ্চাকে পড়িয়ে যে সুখ, যে সন্তুষ্টি তা নিমেষেই অনুভব করল অর্ণব।
তথ্যসূত্র-
https://www.stanfordchildrens.org/en/topic/default?id=anatomy-of-the-skin-85-P01336
https://www.medicalnewstoday.com/articles/320435#function
——————————————
~ কলমে এলেবেলে দিশানী ~
► লেখা ভাল লাগলে অবশ্যই লাইক করুন, কমেন্ট করুন, আর সকলের সাথে শেয়ার করে সকলকে পড়ার সুযোগ করে দিন।
► এলেবেলেকে ফলো করুন।