করোনা নির্ণয়ে PCR পদ্ধতি
আগের সমস্ত ধারণা নস্যাৎ করে সেই ফুটন্ত জলেও বিশেষ ধরণের ব্যাকটিরিয়া বহাল তবিয়তে বেঁচে থাকতে পারে।
কেটে গেল বেশ কয়েক বছর। ততদিনে আণবিক জীববিদ্যা (Molecular Biology) বেশ কিছুটা এগিয়েছে। জীবের বংশগতির ধারক ডিএনএ-র যুগ্ম-সর্পিল গঠন (Double helix structure) আবিষ্কার করে ফেলেছেন ওয়াটসন-ক্রিক সেই কবে (১৯৫৩ সাল)। যুগ্ম সর্পিল ধরা যেতে পারে দুটো সুতো। সুতো দুটোর বৈশিষ্ট্য হল একটা সুতোকে ছাঁচ করে অন্য সুতোটা দিব্যি তৈরি করে ফেলা যায়। যে কোন কোষ, সে ব্যাকটিরিয়া হোক, কি আমাদের দেহের কোষ, যখন একটা থেকে দুটো, দুটো থেকে চারটে হয়, তখন কোষের মধ্যের ডিএনএ-ও স্বাভাবিক ভাবেই দুটো, দুটো থেকে চারটে কপি হতে হতে যায়। এই কপি কে করে? এর জন্য দরকার ডিএনএ পলিমারেজ বলে একটা উৎসেচক (Enzyme) প্রোটিন। অর্থাৎ, একটা সুতো থাকলেই সেটাকে ছাঁচ হিসেবে নিয়ে ডিএনএ পলিমারেজ দক্ষ মিস্তিরির মতন ফটাফট অন্য সুতোটা বানিয়ে ফেলবে। তাহলে জোড়া দুটো সুতোর থেকে ডিএনএ পলিমারেজ এভাবে দুটো, দুটো থেকে চারটে, চারটে থেকে আটটা, আটটা থেকে ষোলটা, এভাবে কোটি কোটি কপি বানাতে পারে। এর মধ্যে আবার ফ্রেডারিক স্যাঙ্গার আবিষ্কার করে ফেলেছেন ডিএনএ ক্রমবিন্যাস (DNA Sequencing) নির্ণয় করার পদ্ধতি (১৯৭৭ সাল)। এজন্যে উনি টেস্টটিউবেই ব্যবহার করেছিলেন ব্যাকটিরিয়া থেকে পাওয়া ডিএনএ পলিমারেজ। বোঝাই যাচ্ছিল, টেস্টটিউবে ডিএনএ পলিমারেজ দিয়ে কোটি কোটি ডিএনএ বানিয়ে ফেলা খালি সময়ের অপেক্ষা। হলও তাই! ১৯৮৩–৮৪ সাল নাগাদ সিটাস বলে অ্যামেরিকার এক কোম্পানির বিজ্ঞানী ক্যারি মুলিস আবিষ্কার করে ফেললেন সেই প্রক্রিয়া। যার নাম পলিমারেজ চেইন রিয়াকশান (PCR) বা পলিমারেজ শৃঙ্খল বিক্রিয়া। শৃঙ্খল বিক্রিয়া কারণ, একেকটা চক্রে ডিএনএ-র কপি দ্বিগুণ হতে থাকে। দুই থেকে চার, চার থেকে আট, এই করে কোটি কোটি। কিন্তু ক্যারি মুলিস একটা সমস্যায় পড়লেন। প্রতি বিক্রিয়া চক্রের শেষে ডিএনএ-র দুটো সুতোকে আলাদা করতে হবে। কারণ আলাদা না করলে, একটা সুতোকে ছাঁচ করে নতুন সুতো তৈরি হবে কি করে! কোষের মধ্যে পদ্ধতিটা অন্য, কিন্তু কোষের বাইরে যুগ্ম সর্পিলকে আলাদা করতে হলে লাগবে তাপ। ৯০–৯৫ ডিগ্রি তাপমাত্রায় এদের মধ্যের বাঁধন টুটবে (Denaturation)। এদিকে সাধারণ ব্যাকটিরিয়া থেকে পাওয়া ডিএনএ পলিমারেজ কাজ করে ৩৭ ডিগ্রি তাপমাত্রায়। ৯০–৯৫ ডিগ্রিতে ডিএনএ পলিমারেজের খেল খতম, তার গঠন ভেঙেচুরে একাকার। তাই ক্যারি মুলিস তখন প্রতি চক্রে নতুন করে ডিএনএ পলিমারেজ যোগ করতে লাগলেন। এর ফলে ব্যাকটিয়া থেকে পাওয়া এই পলিমারেজ লাগছে প্রচুর, আর সারাদিন প্রতি চক্র শেষে একবার করে নতুন পলিমারেজ যোগ করার জন্য সারাদিন বসে থাকতে হত। অর্থাৎ, দুই থেকে চার হল, একবার যোগ করতে হল। চার থেকে আট হল, আবার যোগ করতে হল, তাহলে কোটি কোটি কপি তৈরিতে সারাদিন এই বিরক্তিকর কাজটা করে যেতে হচ্ছে। কি করা যায়, কি করা যায় ভাবতে ভাবতে, ক্যারি এই সময় ATCC ক্যাটালগে Thermus aquaticus-র কথা জানতে পারলেন। ওঁর মনে হল, যে ব্যাকটিরিয়া ৯২ ডিগ্রিতে বেঁচে থাকে, সংখ্যাবৃদ্ধি করে, তার ডিএনএ কপি করে যে পলিমারেজও, সে অনায়াসেই ৯০–৯৫ ডিগ্রি তাপমাত্রা সহ্য করতে পারবে, চোপর দিন এই নতুন করে পলিমারেজ যোগ করতে হবেনা। যেমন ভাবা তেমনি কাজ, বেশ কয়েকবারের চেষ্টায় ক্যারি মুলিজের দলবল Thermus aquaticus থেকে তার ডিএনএ পলিমারেজও উদ্ধার করলেন। দেখা গেল, এই পলিমারেজ ৭০–৭৫ ডিগ্রিতে সবচেয়ে ভাল ডিএনএ কপি করতে পারে, আর দিব্যি সহ্য করতে পারে ৯০–৯৫ ডিগ্রি তাপমাত্রা। ব্যাস! কেল্লা ফতে! শুরু হল পলিমারেজ চেইন রিয়াকশান (PCR)-র জয়যাত্রা। দ্রুত প্রসার ঘটল এই প্রযুক্তির। কয়েক বছরে চলে এল প্রথম স্বয়ংক্রিয় PCR মেশিন বা থার্মোসাইক্লার। যেখানে তাপমাত্রা দ্রুত ৯৫ থেকে ৭২, ৭২ থেকে ৯৫ দ্রুত বদলানো যায়। মাঝে আরেকটা ৫৫ (+/-৫) ডিগ্রি তাপমাত্রাও লাগে অন্য এক ধাপে। ৯৫–৫৫–৭২ এই তিনটি ধাপ মিলে বলা একটি বিক্রিয়া চক্র (Cycle)। মোটামুটি ৩৫ টি চক্র লাগে প্রয়োজনীয় পরিমাণ কপি পেতে। এই ৩৫ টি চক্র সাঙ্গ করতে সারাদিন ধরে তিনটি তাপমাত্রার জলে টেস্টটিউব ডোবাতে হত। থার্মোসাইক্লার আসায় তার পালাও সাঙ্গ হল। থমাস ব্রকের আবিষ্কৃত Thermus aquaticus থেকে পাওয়া Taq পলিমারেজ আর থার্মোসাইক্লার এক লহমায় বদলে দিল অনেক কিছু। আণবিক জীববিদ্যা (Molecular Biology) আর জৈব প্রযুক্তির (Biotechnology)-র গবেষণার এল নতুন যুগ। রসায়নে নোবেল পেলেন ক্যারি মুলিস (১৯৯৩ সাল)।
Thermus aquaticus থেকে পাওয়া Taq পলিমারেজ আর থার্মোসাইক্লার এক লহমায় বদলে দিল অনেক কিছু। আণবিক জীববিদ্যা (Molecular Biology) আর জৈব প্রযুক্তির (Biotechnology)-র গবেষণার এল নতুন যুগ।
অনায়াসে এবং বিরক্তিকর কায়িক শ্রম ছাড়াই সামান্য কয়েকটা ডিএনএ থেকে কোটি কোটি ডিএনএ-র কপি তৈরি হতে লাগল দু-তিন ঘণ্টায়। খালি বিক্রিয়ার সব মাল-মশলা PCR টিউবে ভরে PCR মেশিনে রেখে দিলেই হল। মাঝে দু তিন ঘন্টা দিব্যি গায়ে হাওয়া লাগিয়ে বেড়ান যায়। ফিরে এসে হাতে পাওয়া যাবে কোটি কোটি কপি। এর ফলে, জৈব প্রযুক্তি ও আণবিক গবেষণা ক্ষেত্রে ক্লোনিং সহ নানাবিধ বিষয়ে তো বটেই, রোগব্যাধি নির্ণয়ে, অপরাধ বিজ্ঞানে, চাষ আবাদের ক্ষেত্রেও PCR পদ্ধতির ব্যাপক ব্যবহার শুরু হল। এখন তো সোয়াইন ফ্লু থেকে কোভিড-১৯ মত বিভিন্ন ভাইরাস ঘটিত রোগ নির্ণয়ে PCR পদ্ধতি নিয়মিত ব্যবহার হয়। অপরাধ স্থল থেকে সামান্য রক্তের দাগ, চুলের গোড়া, দাঁত, চামড়ার টুকরো ইত্যাদি থেকে ডিএনএ বার করে, PCR করে, তার বিন্যাসক্রম থেকে সনাক্ত করা হচ্ছে অপরাধী। সিনেমার মত লকেট-উল্কি দেখে বা রাজা সলোমনের গল্পের মত দু টুকরো করার ভয় দেখিয়ে এখন কে কার সন্তান প্রমাণ করতে হয়না, কারণ PCR পদ্ধতি ব্যবহার করে সহজেই প্রমাণ করা সম্ভব, কে কার বাপ, আর কে কার মা! গত ত্রিশ বছরে Taq পলিমারেজের ক্ষমতা বিজ্ঞানীরা নানা কারিকুরি করে আরও উন্নত করেছেন, অন্যান্য উষ্ণ প্রস্রবণ ব্যাকটিরিয়ার থেকেও উন্নততর পলিমারেজ তৈরি ক, রা হয়েছে। বিভিন্ন কোম্পানি চলে আসায় এখন PCR মেশিন সস্তা হয়ে গেছে। আরও উন্নত PCR মেশিন ও প্রযুক্তি তৈরি হয়েছে। এখন এক বিশেষ ধরণের রাসায়নিক ও PCR মেশিন ব্যবহার করে প্রতি চক্রে কত ডিএনএ তৈরি হল তা ধারণা করা যায় (রিয়েল টাইম PCR বা RT-PCR)। যার গবেষণা ক্ষেত্র ছাড়াও, চিকিৎসা ক্ষেত্রেও বহুল ব্যবহার। যেমন, কোভিড পরীক্ষা হচ্ছে এই পদ্ধতিতে। রোগীর থেকে পাওয়া নমুনাতে কত করোনা ভাইরাস আছে, জানতে RT-PCR করা হয়। SARS-COV-2 করোনা ভাইরাস তো আরএনএ ভাইরাস, তাই তার আরএনএ-কে ছাঁচ করে সমান সংখ্যার ডিএনএ তৈরি করা হয় প্রথমে। এবার সেই ডিএনএ-কে PCR-র মাধ্যমে বাড়িয়ে তার উপস্থিতি জানতে হবে। বোঝাই যাচ্ছে, নমুনাতে যত বেশি ভাইরাস থাকবে, তত বেশি ডিএনএ পাওয়া যাবে, ফলে তত কম বিক্রিয়া চক্র বা Cycle লাগবে সেই ডিএনএ দেখতে। PCR বিক্রিয়া চলাকালীন যে চক্রে সেই ডিএনএ-র উপস্থিতি ধরা পড়ে, তাকে বলে Ct (cycle threshold)। অর্থাৎ Ct যত কম; তত বেশি ভাইরাসের উপস্থিতি দেহে। অবশ্য এটা কোন RT-PCR যন্ত্র আর কিট ব্যবহার করা হচ্ছে, তার ওপর কিছুটা নির্ভর করে। তবে খুব বেশি আকাশ পাতাল পরিবর্তন না হবারই কথা। যদি নমুনায় ডিএনএ ৩১–৩২ চক্রেও দেখা না যায়, তবে সেই মুহুর্তে ওই ব্যক্তির কোন সংক্রমণ নেই বলেই ধরা নেওয়া যায়।
ছবিঃ ইয়োলোস্টোন জাতীয় উদ্যানে গ্র্যান্ড প্রিজমাটিক উষ্ণ প্রস্রবণ। ছবি- লেখক।
——————————–
~ কলমে এলেবেলে নির্মাল্য ~
► লেখা ভাল লাগলে অবশ্যই লাইক করুন, কমেন্ট করুন, আর সকলের সাথে শেয়ার করে সকলকে পড়ার সুযোগ করে দিন।
► এলেবেলেকে ফলো করুন।
দারুণ উপস্থাপনা। ভাবি এই ধরনের লেখাপত্র কেনো বাংলা মাধ্যমে স্কুলগুলোতে পড়ানো হয় না!
Covid 19 virus এর RNA কী ভাবে DNA তে convert করা হচ্ছে? সে সম্পর্কে যদি কিছু জানতে পারলে ভালো হয়….
প্রিয় সুপ্রতিমবাবু,
RNA কে ছাচ করে DNA তৈরি করতে ব্যবহার করা হয় REverse TRanscritase বলে একটা enzyme, যেটা HIV বা অন্যান্য রেট্রোভাইরাস ব্যবহার করে পোষক দেহে নিজেদের সংখ্যা বাড়াতে। এই enzyme, RNA, সাথে আরো কিছু উপাদান মিশিয়ে এক ঘন্টা ৪২ ডিগ্রিতে রেখে দিলেই, DNA তোইরী হয় RNA কে ছাঁচ করে