বর্ণপরিচয়
নামটা ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর-এর কাছ থেকে ধার নেওয়া হলেও এই গল্পের আলোচ্য আসলে বস্তুর বর্ণ অর্থাৎ বস্তুর রঙ। আমরা যেভাবে কোনো বস্তুকে দেখতে পাই; যেমন লাল জবা, সবুজ পাতা, অথবা পেনের নীল কালি। রঙের অভাব পৃথিবীর কোনো কিছুতেই নেই, কিন্তু প্রশ্নটা হচ্ছে কখন একটা বস্তু রঙিন হয়? সহজ ভাবে বললে, অন্ধকারে সবকিছুকেই কালো দেখায় অর্থাৎ একটি বস্তুর রঙ বুঝতে গেলে তার উপর আলো পড়া আবশ্যক; কিন্তু অদ্ভুতভাবে এই সাদা বর্ণের আলো কোন পাতার উপর পড়লে তাকে সবুজ দেখায়, গাঁদা ফুলের উপরে পড়লে তাকে হলুদ দেখায়, কি অদ্ভুত তাইনা! এখন তাহলে কৌতূহলের বিষয় বস্তুর রং নির্ভর করে কিসের উপর? যে আলো পড়েছে তার উপর, না কি ওই বস্তুটির উপর। কিছু সহজ পরীক্ষাতেই এর উত্তর পাওয়া যায়। সূর্যালোক যখন একটি কচি পাতার উপর পড়ে, তখন তাকে সবুজ দেখায় কিন্তু যখন সেই একই সূর্যালোক কোন শুকনো পাতার উপর পড়ে তখন তার রঙ হয়ে যায় হলুদ অথবা বাদামী। এই ঘটনাগুলোই প্রমাণ দেয়, বস্তুর রঙ বস্তুর উপর নির্ভর করে। আবার বিভিন্ন অনুষ্ঠানের সময় যখন রাস্তাঘাট আলোকসজ্জায় ভরিয়ে দেওয়া হয়, তখন গাছের দিকে তাকালেও আমরা দেখতে পাই যে গাছের পাতাগুলো আলোকসজ্জার উপর নির্ভর করে বিভিন্ন রঙের দেখাতে পারে অর্থাৎ বস্তুর রঙ বস্তুর উপর কোন বর্ণের আলোর পড়ে, তার ওপর নির্ভর করে। এখন প্রশ্নটা হচ্ছে, এ নির্ভরতাটি কেমন? বস্তুর বর্ণের পেছনের সহজ রহস্যটি বোঝার জন্য আমাদের বস্তুর মধ্যে থাকা ইলেকট্রনগুলির গতিবিধি সম্পর্কে একটা ধারণা করতে হবে। নবম দশম শ্রেণির বিজ্ঞান পাঠ্যবই-এর ধারণা থেকে আমরা সবাই জানি যে সমস্ত বস্তুর মধ্যে কিছু ইলেকট্রন, প্রোটন ও নিউট্রন থাকে। ইলেকট্রনগুলি নিউক্লিয়াসের চারিদিকে বিভিন্ন স্তরে অবস্থান করে। ইলেকট্রনের গতিবিধির সাথে বস্তুর বর্ণের সম্পর্কটা বুঝতে আমরা একটা সহজ উদাহরণ দিতে পারি; ইলেকট্রন আসলে আমাদের মতনই স্বার্থপর— আমরা যেমন কোনো আলোচনার সময আমাদের যতটুকু দরকার ততোটুকুই ভালো করে শুনি, বিভিন্ন বস্তুর মধ্যে ইলেকট্রন ওই বস্তুর উপর পড়া আলোর ঠিক ততটুকুই শোষণ করে যতটুকু শোষণ সে করতে পারবে। বাকি আলো বিচ্ছুরিত হয়ে আমাদের চোখে আসে, অর্থাৎ আলোর যে অংশটা ঐ বস্তুর মধ্যে থাকা ইলেকট্রনগুলি শোষণ করে না আমরা আসলে বস্তু থেকে সেই রঙের দেখি। এই ধরনের ঘটনাকে পরিপূরক বর্ণালী শোষণ বলা হয়ে থাকে। উদাহরণস্বরূপ, পাতার উপর যখন সাদা আলো পড়ে তখন পাতা সবুজ রঙ ব্যতীত বাকি সমস্ত রঙ শোষণ করে; ফলত পাতা থেকে আগত অথবা বিচ্ছুরিত আলো আমাদের চোখে পড়ে আর আমরা ভাবি পাতার রঙ সবুজ।
বর্ণ বা রঙের অবদান সময় ভূগোল নির্বিশেষে যে কোন ইতিহাসে রয়েছে। রঙের খেলার প্রতি মানবিক কৌতুহল অপরিসীম কিন্তু ইতিহাসের একটা বড় সময় ধরে খুঁজতে গেলে পাওয়া যাবে, বস্তুর রঙকে প্রকৃতির নিয়ন্ত্রণাধীন কোন মহাজাগতিক মায়া হিসেবে ধরে রাখা হয়েছে।
কাকতালীয়ভাবে এই বিষয়ে প্রথম আলোকপাত করেন সেই মানুষটি, যার বৈজ্ঞানিক মাথাটা মাথায় আপেল পড়ার পরই খুলেছিল, হ্যাঁ ঠিকই ধরেছেন, নিউটন। বলা যেতে পারে নিউটন যখন প্রথম বিখ্যাত গবেষণাপত্র প্রকাশ করলেন যে সাদা আলো প্রিজমের মধ্য দিয়ে গেলে বর্ণালি সৃষ্টি হয় এবং এর পুরো প্রক্রিয়া, এবং এখানে প্রিজম রঙ সৃষ্টির জন্য নয়, শুধু রঙগুলো পৃথক করার জন্য ব্যবহৃত হয়।
তারপরই বিজ্ঞানী মহল খুঁজতে শুরু করলো রঙের পেছনের কারণগুলো; আর সেই থেকেই একের পর এক গবেষণায় খুঁজে বার করা গেল পাতায় সবুজ রঙের ক্লোরোফিল থেকে হলুদের কারকিউমিন পর্যন্ত। এই রঙের অনুসন্ধান সামনে নিয়ে এলো খনিজ পাথরের রঙ-বেরঙের খেয়ালিপনা। হাতের আংটি ধারন-এর পেছনের ভাগ্য ফেরানোর কথা ভাবা হলেও খুব কম মানুষই সেই পাথরের রঙের কারণ নিয়ে উৎসাহ দেখিয়েছে। আধুনিক গবেষণা পাথরগুলির রঙের পেছনে তাদের উৎসের ভৌগলিক অবস্থান এবং মাটিতে থাকা বিভিন্ন মৌলের উপস্থিতিকেই হরেক বর্ণের কারণ হিসেবে উল্লেখ করেছে। রাশি পাথর হিসেবে আমরা যা ধারণ করি তার বেশিরভাগেরই প্রধান উপাদান অ্যালুমিনিয়াম অক্সাইড। তারই মধ্যে বিভিন্ন সন্ধিগত মৌল যেমন ক্রোমিয়াম (রুবী), আয়রন (লাল কোরাল), টাইটেনিয়াম (ক্যাটস আই), কপার ( ব্লু সাফায়ার) ইত্যাদির উপস্থিতি দেখতে পাওয়া যায়। এভাবেই রঙের সাথে বিভিন্ন ধরনের উপাদানের সংযোগ স্থাপিত হয়।
বর্ণালী বিদ্যার প্রয়োগ করে উপাদান সংক্রান্ত গবেষণা যখন ধীরে ধীরে গুণোত্তর প্রগতিতে হতে শুরু করে, তখন বামনের চাঁদে হাত দেওয়ার অবকাশ আসে। কিন্তু এর জন্য আর বামনকে চাঁদে পৌঁছতে হয়না, চাঁদ ও দূর-দূরান্তের মহাজাগতিক আকাশে ভেসে থাকা গ্রহ উপগ্রহ থেকে আসা বিকিরণ বিশ্লেষণ করে আজ মানুষ বলে দিতে পারে মঙ্গল গ্রহের লাল রঙের পেছনে থাকা লৌহ আকরিকের উপস্থিতি অথবা সূর্যের শক্তির উৎস হিসাবে হিলিয়াম-এর উপস্থিতির কথা। মহাজাগতিক গবেষণায় পৃথিবীর ন্যায় বাসযোগ্য গ্রহ খোঁজার পেছনে বর্ণালী গবেষণার বড় ভূমিকা রয়েছে আর তারই ফসল ৬০০ আলোকবর্ষ দূরে কেপলার-২২ বা ২০ আলোকবর্ষ দূরে জার্মিনা নামক গ্রহের উপস্থিতি জানা। বর্তমানে শক্তিশালী বর্ণালিবীক্ষণ যন্ত্র এবং কম্পিউটারের ক্ষমতার সুবাদে আমরা দূর-দূরান্তের গ্রহের গতি প্রকৃতি, আকার সম্পর্কেও তথ্য জানতে পারি।
রঙ বস্তুর এমন একটি ধর্ম যে মানুষকে যুগ-যুগান্তর ধরে প্রভাবিত করে এসেছে এবং আজও করে চলেছে। রঙ এবং তার পেছনে থাকা তরঙ্গের বিষয়ে গবেষণা আজও প্রাসঙ্গিক এবং সেই ক্ষেত্র আজও নতুন নতুন বিষয় মানবজাতির কাছে প্রতিষ্ঠা করে চলেছে।
**( সমস্ত চিত্র উইকিপিডিয়া থেকে সংগৃহীত)
———————————–
~ কলমে এলেবেলের অতিথি রজত মুখার্জি ~
রজত মুখার্জি আই.আই. টি. মুম্বাই-এর রসায়ন বিদ্যার (বিষয়: বর্ণালি বিদ্যা) গবেষক।
► লেখা ভাল লাগলে অবশ্যই লাইক করুন, কমেন্ট করুন, আর সকলের সাথে শেয়ার করে সকলকে পড়ার সুযোগ করে দিন।
► এলেবেলেকে ফলো করুন।
ইলেকট্রন তো ঋণাত্মকধর্মী। আর আলো তড়িৎচৌম্বকীয় তরঙ্গ। শোষণটা তাহলে ঠিক কীভাবে হয় এবং ইলেকট্রন ই কেন ? কোনো সমীকরণ আছে কী ?
তুমি যদি পরমাণুর বিন্যাস তা ভালোভাবে খেয়াল করো, দেখবে প্রোটন ও নিউট্রন পরমাণু নিউক্লিয়াসের মাঝে আবদ্ধ নিউক্লিয় শক্তি দ্বারা, আর দৃশ্যমান আলোর ক্ষমতা এই শক্তির থেকে অনেক কম। তাই দৃশ্যমান আলো প্রোটন এবং নিউট্রন কে স্থানচ্যুত করতে পারেনা। তুলনায় ইলেকট্রন বাইরের কক্ষপথে ভ্রাম্যমাণ,যার উপর আলো পড়লে সে সেই আলোর শক্তি শোষণ করে এক কক্ষ থেকে কক্ষ এ স্থানান্তরিত হতে পারে। এখানে ইলেকট্রন একটি বস্তু হিসেবে আলো শোষণ করে, তার আধান বিশেষ কোনো ভূমিকা রাখে না।
যাদের লেখাটিকে ভালো লেগেছে, তাদের অসংখ্য ধন্যবাদ, আপনাদের মন্তব্য আরো বেশি করে বিজ্ঞানমনস্ক লেখা লিখতে অনুপ্রেরণা দেবে।