সিনেমার মতো
সাংহাই শহরের একটা গলি। সেখানে একটা ঘুপচি অগোছালো দোকান। হিন্দিতে লেখা ভারত ভগবান তেল কি দুকান। দোকানে একদিকে লোলজ্বিহা ভয়ঙ্কর মহাকালী মূর্তি, অন্যদিকে বলিউড স্টারদের ছবি। আধা অন্ধকারে উচ্চস্বরে বাজছে হিন্দি সিনেমার গান। দোকানটির মালিক চেং ইয়োং। সে ভারতীয় যৌনশক্তি বর্ধক ওষুধ বিক্রি করে। কিন্তু বিক্রিবাট্টা কিছু নেই তার দোকানে। তাই খুবই আর্থিক সমস্যায়, সাথে আরও নানা সমস্যায় জর্জরিত। একদিকে অসুস্থ বুড়ো বাবার চিকিৎসার খরচ। সাথে বিয়ে ভেঙে গেছে, স্ত্রী একমাত্র ছেলেকে নিয়ে বিদেশের পাড়ি দিতে চায় চিরতরে। কোন দিকেই কোন দিশা খুঁজে পায়না চেং। এসময় ওর দোকানে মুখে মেডিকাল মাস্ক পরা একটি লোক আসে। লোকটি জানায়, ও Chronic myeloid leukemia বা CML আক্রান্ত। এই ক্যান্সারের পেটেন্টেড ওষুধ কিনতে তার মাসে সাইত্রিশ হাজার ইউয়ুন খরচ হয় (ভারতীয় মুদ্রায় চার লক্ষ টাকারও বেশি), কিন্তু ভারতে এই একই ওষুধ অন্য কোম্পানি তৈরি করে, যার দাম মাত্র দু’হাজার ইয়ুন (প্রায় তেইশ হাজার টাকা)। লোকটি ওকে বলে, ও তো ভারত থেকে এসব ভেষজ ওষুধের চোরা পথেই আনায়। তার বদলে ও যদি ক্যান্সারের এই ওষুধটা ভারত থেকে আনাতে পারে তাহলে অনেক রুগী, যারা এই ওষুধ কিনতে গিয়ে সর্বশান্ত হয়ে যাচ্ছে, তারা বাঁচবে আর চেং-ও বড়লোক হয়ে যাবে। প্রথমে চেং কড়া আইনের ভয়ে রাজি হয়না। কিন্তু এরপর বাবার চিকিৎসার জন্য প্রচুর টাকার দরকার হয়ে পড়লে বাধ্য হয়ে রাজি হয়। চেং দিল্লি আসে ওষুধ কিনতে। অত্যন্ত গোপনে চোরা পথে ভারতীয় ওষুধ নিয়ে ঢোকে চিনে।
ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের পর ২০০১ সালে বিখ্যাত সুইস ওষুধ কোম্পানি নোভার্টিস বাজারে নিয়ে আসে খাবার ট্যাবলেট হিসেবে এই ওষুধ, Gleevec নামে। Gleevec প্রায় অলৌকিক ফল দেখায়।
গল্পটা এগোবার আগে আমরা একটু CML আর তার ওষুধ নিয়ে ব্যাপারটা আলোচনা করে নিই। তাহলে গল্পটা বুঝতে আরেকটু সুবিধে হবে। Chronic myeloid leukemia হল একধরণের অস্থিমজ্জার ক্যান্সার। এর ফলে রক্তে শ্বেত কণিকার পরিমাণ অস্বাভাবিক ভাবে বৃদ্ধি পায়। এই ক্যান্সারের কারণটা খুব অদ্ভুত। আমাদের দেহের প্রতিটি কোষে ২৩ জোড়া ক্রোমোজোম আছে, আমরা জানি। ক্রোমোজোম তৈরি বংশগতির ধারক DNA সুতো দিয়ে। নব্বই শতাংশ CML রোগীর রক্তের একটি অস্বাভাবিক ঘটনা ঘটে। ৯ নং ক্রোমোজোমের আর ২২ নং ক্রোমোজোমের দুটো টুকরো অদল বদল হয়ে যায়। বাইশের টুকরো নয় নম্বরে, আর নয়ের টুকরো বাইশে। এর ফলে মাইক্রোস্কোপের তলায় ২২ নং ক্রোমোজোমকে অস্বাভাবিক ছোট দেখতে লাগে। ফিলাডেলফিয়ার ফক্সচেজ সেন্টারের গবেষণাগারে এই অস্বাভাবিক ক্রোমোজোমটি আবিষ্কার হয়েছিল বলে একে ‘ফিলাডেলফিয়া ক্রোমোজোম’ বলা হয়। এই সংযুক্ত হবার ফলে, ২২ নম্বরের ক্রোমোজোমে থাকা BCL জীনের সাথে ৯ নম্বরের ABL জীন সংযুক্ত হয়ে তৈরি হয় এক ভয়ঙ্কর বিপজ্জনক জীন BCR-ABL (ছবিতে দেখানো আছে। https://www.cancer.gov/ থেকে প্রাপ্ত)। এই BCR-ABL থেকে যে প্রোটিনটি তৈরি হয়, সেটিই শ্বেত রক্তকণিকা বা শ্বেত রক্তকোষের (White Blood Cell, WBC) বিভিন্ন জৈবরাসায়নিক পথকে অতিরিক্ত সক্রিয় করে তোলে, ফলে শ্বেত রক্তকণিকার বৃদ্ধিতে আর কোন লাগাম থাকে না, ক্যান্সার কোষে পরিণত হয়ে সংখ্যায় হু হু করে বাড়তে থাকে, আর অন্যদিকে লোহিত রক্ত কণিকা (White Blood Cell, RBC), যা অক্সিজেন বহন করে তা কমতে থাকে। তবে এই রোগ বংশগত নয়, ‘ফিলাডেলফিয়া ক্রোমোজোম’ জন্মের পর তৈরি হয়। যখন এই রোগের যন্ত্রণাদায়ক কেমোথেরাপি, অস্থিমজ্জা প্রতিস্থাপন বা মৃত্যু, এছাড়া আর কোন বিকল্প ছিল না, সেই সময় নয়ের দশকে আবিষ্কার হয় CML-র ওষুধ Imatinib। Imatinib BCR-ABL এর সক্রিয়তা বন্ধ করে, তার কাজ ভণ্ডুল করে, ফলে ক্যান্সার কোষের সংখ্যা বৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণে আসে। ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের পর ২০০১ সালে বিখ্যাত সুইস ওষুধ কোম্পানি নোভার্টিস বাজারে নিয়ে আসে খাবার ট্যাবলেট হিসেবে এই ওষুধ, Gleevec নামে। Gleevec প্রায় অলৌকিক ফল দেখায়। যেহেতু এই অদ্ভুত BCR-ABL প্রোটিন খালি শ্বেতকণিকার ক্যান্সার কোষেই থাকে, তাই সেই কোষগুলোতে BCR-ABL-র সক্রিয়তা Imatinib বন্ধ করে, ফলে ক্যান্সার মুক্ত না হলেও Imatinib ব্যবহার করে দীর্ঘদিন এই ক্যান্সার নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়। এই দুর্দান্ত ফলের জন্য ক্যান্সার চিকিৎসার ক্ষেত্রে Imatinib-কে পোস্টার বয় ড্রাগ হিসেবে বলা হয়। কিন্তু প্যাটেন্টেড ড্রাগ হিসেবে, নোভার্টিস যখন ২০০১ সালে Gleevec বাজারে ছাড়ে, এর খরচ ছিল বছরে ছাব্বিশ হাজার ডলার (তখনকার হিসেবে বছরে বারো লাখ টাকারও বেশি)। যা বাড়তে বাড়তে প্যান্টেট ফুরবার বছরে (২০১৩ সালে) দাঁড়ায় এক লক্ষ কুড়ি হাজার ডলারে (পঁচাত্তর লাখেরও বেশি), এক লক্ষ ছেচল্লিশ হাজার ডলারে (২০১৬ সালে)। প্রতি বছর বাঁচিয়ে রাখার জন্য, এটা খরচ প্রায় অসম্ভব বেশির ভাগ মানুষের পক্ষে। প্যান্টেন্ট চলে যাবার পর ২০১৭ সালে অবশ্য দাম কমে হয় ন’হাজার ডলার (প্রায় সাত লক্ষ টাকা, যদিও এটাও বিরাট খরচা দরিদ্র তো বটেই, যে কোন মধ্যবিত্ত পরিবারের জন্যও)। এদিকে ভারতে বেশ কয়েকটি ঔষুধ প্রস্তুতকারী সংস্থা Imatinib প্রস্তুত শুরু করে দিয়েছিল। ২০০৬ সালেই নোভার্টিস এজন্য মামলা ঠোকে। তাদের সুপ্রিম কোর্টে Gleevec এর প্যাটেন্ট সুরক্ষা বাড়াতে চেয়ে আবেদন ১ এপ্রিল, ২০১৩ সুপ্রিম কোর্ট প্রত্যাখ্যান করেন। আদালতের এই ঐতিহাসিক রায় দেশীয় প্রস্তুতকারকদের জন্য এবং সাথে বিরাট সংখ্যক রোগীর জন্য স্বস্তি নিয়ে আসে। নোভার্টিস সহ অন্যান্য বিদেশী কোম্পানিগুলো স্বাভাবিক ভাবেই তাদের ক্ষোভ উগড়ে দেয় এই রায়ে। অবশ্য সারা বিশ্ব জুড়ে আগে থেকেই Gleevec -র অস্বাভাবিক দাম নিয়ে প্রশ্ন উঠছিলই। দাম কমাবার জন্য বিশ্বের ক্যান্সার গবেষক বিজ্ঞানীরাও যৌথ ভাবে লিখিত পত্র দিয়েছিলেন ‘Blood’ জার্ণালে। কারণ, খালি Gleevec-ই নোভার্টিসকে তিনশো কোটি ডলারের ব্যবসা দিচ্ছিল বছরে (২০১৩)। এদিকে গবেষণায় খরচ সেখানে মোট দেড়শ থেকে আড়াইশো কোটি ডলার। যদিও ওষুধ কোম্পানিদের বক্তব্য ছিল, প্রতি দশটি ওষুধে মাত্র তিনটি ওষুধ শেষ পর্যন্ত বাজার জাত হতে পারে। তাই এরকম করে যদি সফল ওষুধ থেকে লাভ না ওঠানো যায়, তবে তো গবেষণাই বন্ধ করে দিতে হয়। এসব ক্ষোভের মধ্যেই সুপ্রিম কোর্টের রায়ের পরে বহু কোম্পানিই Imatinib তৈরি শুরু করে। বর্তমানে সবকটির দামই মোটামুটি দুশোর আশেপাশে। মানে বছরে এখন খরচ সত্তর-আশি হাজার। এমনকি Gleevec-র তাই দাম কমলো প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে।
২০০৬ সালেই নোভার্টিস এজন্য মামলা ঠোকে। তাদের সুপ্রিম কোর্টে Gleevec এর প্যাটেন্ট সুরক্ষা বাড়াতে চেয়ে আবেদন ১ এপ্রিল, ২০১৩ সুপ্রিম কোর্ট প্রত্যাখ্যান করেন। আদালতের এই ঐতিহাসিক রায় দেশীয় প্রস্তুতকারকদের জন্য এবং সাথে বিরাট সংখ্যক রোগীর জন্য স্বস্তি নিয়ে আসে।
এবার চেং-র গল্পে ফেরা যাক। সেই দোকানের প্রথম CML রুগীর সাথে চেং-র একটা অদ্ভুত ধরণের বন্ধুত্ব হয়ে যায়। সেই লোকটির CML রোগীদের নেটওয়ার্কের মাধ্যমে গোপন এই ভারতীয় জেনেরিক ওষুধ ছড়িয়ে যায় চিন জুড়ে। এই কর ছাড়া গোপন রোজগারে চেং প্রবল ধনী হয়ে যায়। তখন সে Imatinib-র ব্যবসা বন্ধ করে অন্য প্রকাশ্য ব্যবসা শুরু করে ও ধনী হয়ে ওঠে। ভুলে যায় তার বন্ধুকে। কারণ, সে আগেই কথা প্রসঙ্গে বলেছিল, সে কোন রক্ষাকর্তা নয়, এই ব্যবসা করে ধনী হতে চায় মাত্র। বন্ধু তখন মৃত্যুশয্যায়। বন্ধুর স্ত্রী চেং-র হাতে পায়ে ধরে এসে ওষুধের ব্যবস্থা করে দেবার জন্য। চেং হাসিখুশি বন্ধুকে ওই রকম যন্ত্রণা ক্লিষ্ট মৃত্যুর জন্য অপেক্ষারত দেখে প্রবল অনুতপ্ত হয়। সে আবার ভারত থেকে Imatinib চোরা চালান শুরু করে। বন্ধু বাঁচেনা, কিন্তু হাজার হাজার অন্যান্য রুগীর প্রাণ বাঁচে। কোন লাভ ছাড়াই প্রায় বিলি করছিল ওষুধ, কিন্তু এবার ধরাও পড়ে গেল। তিন বছরের জেলও হল। কিন্তু জেলে যাবার সময় গাড়ির খাঁচার ফাঁক দিয়ে দেখল, বহু CML রুগী সজল চোখে ওকে কৃতজ্ঞতা জানাতে রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে আছে, ভিড়ের মধ্যে ও ওর সেই পুরনো বন্ধুকেও যেন হাসি মুখে দেখতে পায়। গল্প শেষ হয়। এটি ২০১৮ সালে তৈরি একটি চিনা ছবির গল্প বললাম। ছবিটির নাম ‘Dying to Survive’। এটি কিন্তু চিনের একটি সত্যি ঘটনার আদলেই তৈরি। যদিও সেক্ষেত্রে মুখ্য চরিত্র নিজেই CML আক্রান্ত ছিল।
এই সিনেমা মুক্তির পর চিনে প্রবল আলোড়ন হয়। সরকারকেও নড়ে চড়ে বসতে হয়। চিন সরকার ক্যান্সারের ওষুধগুলোর ওপর আমদানি শুল্ক তুলে নেয় এবং ওষুধ কোম্পানিগুলোকে ক্যান্সার ওষুধের দাম কমাবার আদেশ জারি করে।
এই সিনেমা মুক্তির পর চিনে প্রবল আলোড়ন হয়। সরকারকেও নড়ে চড়ে বসতে হয়। চিন সরকার ক্যান্সারের ওষুধগুলোর ওপর আমদানি শুল্ক তুলে নেয় এবং ওষুধ কোম্পানিগুলোকে ক্যান্সার ওষুধের দাম কমাবার আদেশ জারি করে। চিনের যে সার্বজনীন স্বাস্থ্য ব্যবস্থা, তাতে ক্যান্সারের ওষুধকে ঢোকাবার প্রস্তাব গৃহীত হয় কয়েটি রাজ্যে। এছাড়া কেউ যদি কম পরিমাণে বাইরে থেকে ওষুধ আনায় ও তাতে সেরকম কোন পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া না দেখা যায়, তবে সেটা আর অপরাধ হিসেবে গণ্য হবেনা বলে সরকার আইন আনে। এই সিনেমাটি মানুষের অব্যক্ত যন্ত্রণা ও অসহায়তা তুলে ধরার জন্য দেশে বিদেশে প্রচুর প্রশংসিত হয়। খালি প্রশংসাই নয়, প্রচন্ড জনপ্রিয়ও হয়, জিতে নেয় বহু পুরস্কার। এবং চিনের সর্বকালের সেরা বাণিজ্যসফল ছবিগুলোর মধ্যে জায়গা করে নেয়। খুব গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে বলা হলেও আদতে কিন্তু সিনেমাটি বিনোদনমূলক। নাটকীয়তা, ঘটনার ঘনঘটা, চরিত্রগুলির একদিকে অসহায়তা আবার অন্যদিকে কৌতুক, সবই আছে। আর ভারতীয় অভিনেতা শাহবাজ খান আছেন একটি বিশেষ চরিত্রে।
———————————-
~ কলমে এলেবেলে নির্মাল্য ~
► লেখা ভাল লাগলে অবশ্যই লাইক করুন, কমেন্ট করুন, আর সকলের সাথে শেয়ার করে সকলকে পড়ার সুযোগ করে দিন।
► এলেবেলেকে ফলো করুন।
খুব সুন্দর। রূপকথার গল্পও হার মানবে দেখছি।