ভূ-তাপীয় শক্তি (প্রথম পর্ব)
আজ বৈকালিক আড্ডায় শুভাশিস, সুবিমল এবং সুনীল অর্থাৎ খুড়োর পাঠশালার সবাই হাজির কিন্তু গুরুমশাই অর্থাৎ খুড়ো এখনো এসে পৌঁছননি। সুবিমল বলে, “আজকে খুড়ো এলেই চমকে দেব।” সবার জিজ্ঞাসু চোখের দিকে তাকিয়ে সুবিমল বলে “সেদিন খুড়ো আমাদের ‘বিদ্যুৎ বাঁচিয়ে পরিবেশ বাঁচাও’ প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে অপ্রচলিত শক্তি সম্বন্ধে অনেক কিছুই বলল, কিন্তু সেগুলো ছাড়াও আমি আরও দু’একটার সন্ধান পেয়েছি ইন্টারনেট ঘেঁটে। সে সম্বন্ধে তো খুড়ো কিছু বললনা। আজকে এলেই আমি জিজ্ঞেস করব।” এ কথা বলতে না বলতেই খুড়োর প্রবেশ। যথারীতি সঙ্গে সঙ্গে চা হাজির। খুড়ো কপালের ঘাম মুছে চায়ের কাপে এক দীর্ঘ চুমুক দিয়ে বলল, “আজকে দেখছি ঠিক সময়ে সবাই হাজির, আমারই দেরী হয়ে গেল।”
সুবিমলের প্রশ্নবাণ খুড়োর দিকে— “তোমাকে কি একটা প্রশ্ন করতে পারি ?” “হ্যাঁ বলেই ফ্যাল।”— খুড়োর জবাব। “আমাদের ঘরের কাছে বক্রেশ্বর, রাজগীর বা হিমাচলের মনিকরণে অথবা সুন্দরবনের সমুদ্র তটবর্তী অঞ্চলে যদি অপ্রচলিত শক্তির সন্ধান করতে হয় তবে তোমার কি পরামর্শ?” “আমি বুঝেছি তুই এ ব্যাপারে কিছু পড়াশুনো করেছিস— এবারে আমাকে টেক্কা দিতে চাস? খুব ভালো কথা। আমি তো এটাই চাই— তোরা যদি গুরুমারা চেলা হতে পারিস তবে আমিই কিন্তু সবচেয়ে বেশি খুশি হব। তোর প্রথম প্রশ্নের জবাব হচ্ছে জিওথার্মাল অথবা ভূ-তাপীয় শক্তি এবং দ্বিতীয়টার জবাব হচ্ছে টাইডাল এনার্জি অথবা জোয়ার ভাঁটা থেকে উৎপন্ন শক্তি। অবশ্য সুন্দরবনে সৌর এবং বায়ুচালিত বিদ্যুৎ উৎপাদনেরও অনেক সুযোগ আছে। তোরা হয়ত ভাবছিস এই ভূ-তাপীয় শক্তি ও টাইডাল এনার্জি প্রসঙ্গে আমি তো তোদের আগে কিছু বলিনি। তার কারন হচ্ছে এই শক্তিগুলির ব্যবহারিক প্রয়োগ এখনো আমাদের দেশে অপ্রাসঙ্গিক। তবে তোদের মনে যখন প্রশ্ন জেগেছে উত্তর তো আমাকে দিতেই হবে। আজকে তাহলে ভূ-তাপীয় শক্তি সম্বন্ধে কিছু আলোচনা করা যাক।”
“জিওথার্মাল অথবা ভূ-তাপীয় শক্তি হল এক ধরণের অপ্রচলিত শক্তি, যা পৃথিবীর পৃষ্ঠের নীচের স্তরে উপস্থিত তাপ থেকে পাওয়া যায়। বর্তমানে ভূ-তাপীয় শক্তি বাণিজ্যিকভাবে বিদ্যুৎ উৎপাদন ও তাপ শক্তির প্রয়োজনীয়তা পূরণের জন্য ব্যবহৃত হচ্ছে। পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ভূ-তাপীয় বিদ্যুৎ কেন্দ্র হচ্ছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সানফ্র্যান্সিসকোর কাছে মায়াকামাস পাহাড় সংলগ্ন গীজার কমপ্লেক্স যার সম্মিলিত বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা প্রায় ১৫০০ মেগাওয়াট। এছাড়া ইতালি এবং মেক্সিকোতেও প্রায় ৭০০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন বিদ্যুৎ কেন্দ্র আছে। ইতালি, নিউজিল্যান্ড, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, মেক্সিকো, ফিলিপিন্স, ইন্দোনেশিয়া এমন কয়েকটি দেশ যারা বিদ্যুৎ উৎপাদন ও তাপ প্রয়োগের জন্য ভূ-তাপীয় শক্তি ব্যবহার করে। তবে সম্ভাবনাময় উৎপাদনের নিরিখে সবচেয়ে উপরে আছে ইন্দোনেশিয়া, তারপরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ফিলিপিন্স।”
সুবিমলের প্রশ্ন “এই ভূ-তাপীয় শক্তি কোথা থেকে আসে ?” খুড়োর জবাব, “ভূ-তাপীয় শক্তি পৃথিবীর প্রাকৃতিক তাপ। পৃথিবীর অভ্যন্তরীণ তাপ প্রায় সাড়ে চার বিলিয়ন বছর আগে পৃথিবীর জন্মের সময় উৎপন্ন হয়েছিল। পৃথিবীর ভূত্বক বা পৃষ্ঠের নীচে প্রায় ২৯০০ কিলোমিটার অভ্যন্তরে আমাদের গ্রহের সবচেয়ে উষ্ণতম অংশ হচ্ছে কোর বা মূল যার তাপমাত্রা ৪০০০–৭০০০ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত হয়ে থাকে। কোর-এর উত্তাপের একটা অংশ পৃথিবী সৃষ্টির সময় ঘর্ষণ এবং অভিকর্ষীয় বল থেকে তৈরি হয়েছিল। পৃথিবী প্রদত্ত তাপের প্রায় ৫০% তাপ ইউরেনিয়াম, থোরিয়াম এবং পটাসিয়ামের আইসোটোপের মতো উপাদানগুলির তেজস্ক্রিয় ক্ষয় দ্বারা সৃষ্টি হয়। মাটির তলার গভীরতা বৃদ্ধির সাথে সাথে তাপমাত্রা বৃদ্ধি পায়— প্রতি কিলোমিটারে ১৭–৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত।” শুভাশিস বলে “হ্যাঁ আমরা ভূগোল বইতে পড়েছি যে ভূত্বকের নীচে ম্যান্টেল রয়েছে যা আংশিক গলিত শিলা দিয়ে তৈরি। ভূত্বকের নীচের এই তরল গলিত শিলা এবং খনিজগুলিকে ম্যাগমা বলে। মূল বা কোর থেকে নির্গত উত্তাপ ক্রমাগত শিলা, জল, গ্যাস এবং অন্যান্য ভূগর্ভস্থ পদার্থকে উত্তপ্ত করছে।” খুড়ো বলেন “একদম ঠিক বলেছিস। টেকটোনিক প্লেটে ফাটল যুক্ত অঞ্চলগুলিতে ভূ-তাপীয় শক্তি পৃথিবীপৃষ্ঠের নীচের জলকে উত্তাপ দেয়। এ থেকে ওঠা বাষ্প বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য বিদ্যুৎকেন্দ্রের টারবাইনগুলিকে ঘোরানোর কাজে ব্যবহৃত হয়।”
শুভাশিস বলে “এই ভূ-তাপীয় শক্তি ভারতের কোথায় কোথায় পাওয়া যায়?” খুড়োর জবাব, “ভারতের মধ্যে সবচেয়ে সম্ভাবনাময় ভূ-তাপীয় শক্তির সম্ভাব্য স্থানগুলি হচ্ছে জম্মু কাশ্মীরের পুগা উপত্যকা, ছত্তিসগড়ের তত্তপানি, হিমাচল প্রদেশের মনিকরণ, পশ্চিমবঙ্গের বক্রেশ্বর, গুজরাটের তুওয়া, মহারাষ্ট্রের জলগাঁও, বিহারের রাজগীর ইত্যাদি অঞ্চল। এই ভূতাত্ত্বিক ক্ষেত্র অনুসন্ধানে ভূতত্ত্ব, ভূ-রসায়ন, ভূমিকম্প-বিজ্ঞান, জলবিদ্যুৎ এবং জলাধার ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের সম্যক জ্ঞান প্রয়োজন। ভারতে ভূতাত্ত্বিক ক্ষেত্রগুলির সন্ধান এবং গবেষণা ১৯৭০ সালে শুরু হয়েছিল। জিএসআই (ভারতের ভূতাত্ত্বিক জরিপ সংস্থা) দেশে ৩৫০টি ভূ-তাপীয় শক্তির অবস্থান চিহ্নিত করেছে। এর মধ্যে সবচেয়ে প্রতিশ্রুতিময় স্থান হচ্ছে লাদাখের পুগা উপত্যকা। ভূ-তাপীয় শক্তি সন্ধান এবং গবেষণাক্ষেত্রে কাজ করা ভারতীয় সংস্থাগুলি হচ্ছে কেন্দ্রীয় বিদ্যুৎ কর্তৃপক্ষ বা সিইএ, ভারতের ভূতাত্ত্বিক জরিপ সংস্থা বা জিএসআই, ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজি মুম্বই, আঞ্চলিক গবেষণা পরীক্ষাগার জম্মু, ন্যাশনাল জিওফিজিকাল রিসার্চ ইনস্টিটিউট হায়দ্রাবাদ এবং তেল ও প্রাকৃতিক গ্যাস কর্পোরেশন বা ওএনজিসি। ভারতে এখনো পর্যন্ত পুরোপুরি কার্যক্ষম কোনও জিওথার্মাল পাওয়ার প্ল্যান্ট নেই। তবে ভারতে ভূ-তাপীয় শক্তি ব্যবহারের সম্ভাবনা বিশাল। ভবিষ্যতে ভূ-তাপীয় বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের ক্ষমতা ধরা হয়েছে ১০,৬০০ মেগাওয়াট।”
সুনীল প্রশ্ন করে “অন্যান্য বিদ্যুৎ কেন্দ্রের সঙ্গে এর কি পার্থক্য?” “কয়লা, গ্যাস, পারমাণবিক শক্তি বা অন্য শক্তি দ্বারা চালিত সকল বিদ্যুৎ কেন্দ্রের মূল বৈশিষ্ট্য হচ্ছে যে তারা তাপকে বিদ্যুতে রূপান্তরিত করে। ভূ-তাপীয় বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলিতে প্রচলিত বিদ্যুৎ উৎপাদন স্টেশনগুলির মত টারবাইন, জেনারেটর, ট্রান্সফরমার এবং বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য অন্যান্য সকল সরঞ্জামেরই প্রয়োজন আছে, একমাত্র বয়লার ছাড়া। তেল অনুসন্ধানের জন্য যেমন কূপ খনন করা হয়, অনুরূপ প্রক্রিয়াতে জল বা বাষ্পকূপের সাহায্যে পৃথিবীর অভ্যন্তরের নির্দিষ্ট স্তর থেকে তাপ বা ভূ-তাপীয় শক্তি সংগ্রহ করা হয়”— খুড়োর জবাব।
সুবিমল বলে “একটু সংক্ষেপে যদি বল এই বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলি কীভাবে কাজ করে?” খুড়ো শুরু করেন, “বলছি, শোন মন দিয়ে। ভূ-তাপীয় পাওয়ার প্ল্যান্ট সাধারণত তিন প্রকারের হয়— শুকনো বাষ্প শক্তি কেন্দ্র, ফ্ল্যাশ বাষ্প শক্তি কেন্দ্র এবং বাইনারি চক্র বিদ্যুৎ কেন্দ্র। শুকনো বাষ্প বিদ্যুৎ কেন্দ্র প্রাচীনতম এবং সর্বাধিক সহজ পদ্ধতির উপর নির্ভর করে নির্মিত বিদ্যুৎ কেন্দ্র। কিন্তু ফ্ল্যাশ এবং বাইনারি চক্র বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলি অপেক্ষাকৃত নতুন এবং উন্নত সংস্করণের।”
“যখন ভূ-তাপীয় শক্তি ১৫০ ডিগ্রি সেলসিয়াস বা তার বেশি তাপমাত্রায় থাকে, তখন জলাধার থেকে সরাসরি বাষ্প পাওয়া যায়। মাটির নীচ থেকে উত্তোলিত তরল তখন সরাসরি বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে ব্যবহার করা হয়। মাটির গভীরে উচ্চ চাপে থাকা গরম জল পাম্প করে উপরে তোলার সময় যখন এই জল ভূপৃষ্ঠতলে পৌঁছয় তখন চাপ কমে যায়, যার ফলে জল বাষ্পে পরিণত হয়। এই বাষ্প টারবাইনকে ঘোরায় যা একটি জেনারেটরের সাথে সংযুক্ত থাকে। এই জেনারেটর বিদ্যুৎ উৎপন্ন করে। এই বাষ্প পরে ঠান্ডা হয়ে জলে পরিনত হয় এবং অন্য পাইপ দিয়ে মাটির তলায় ফিরে যায়।
ফ্ল্যাশ বাষ্প বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলিতে ভূগর্ভস্থ গরম জল এবং বাষ্পের প্রাকৃতিক উৎসকে ব্যবহার করা হয়। পৃথিবীর গভীর থেকে উচ্চ-চাপের উত্তপ্ত জল ও বাষ্পের সংমিশ্রণ (১৮০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের-এর চেয়েও বেশি) একটি নিম্নচাপযুক্ত অঞ্চলে পাম্প করা হয়। তার ফলে ফ্ল্যাশ ট্যাঙ্কের মধ্যে অধিকাংশ উত্তপ্ত জল সঙ্গে সঙ্গে বাষ্পে পরিনত হয়। সেই বাষ্প চালনা করা হয় টারবাইন ঘুরিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য। বাষ্প ঠান্ডা হয়ে গেলে তা জলে পরিনত হয় এবং পুনঃ ব্যবহারের জন্য মাটিতে ফিরিয়ে দেওয়া হয়। বেশিরভাগ ভূ-তাপীয় বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলি হল ফ্ল্যাশ স্টিম প্ল্যান্ট শ্রেণীর।” সুবিমলের প্রশ্ন, “এই যে বললে, বাষ্প ঠান্ডা হয়ে জলে পরিনত হয়, এটা কি স্বাভাবিক ভাবে হয়?” “ভালো প্রশ্ন করেছিস। এই বাষ্পকে ঠান্ডা করে জলে পরিনত করার জন্য কুলিং টাওয়ারের প্রয়োজন হয়”— খুড়োর জবাব।
“বাইনারি চক্র বিদ্যুত কেন্দ্রগুলি জল সংরক্ষণ এবং তাপ উৎপন্ন করতে একটি অনন্য প্রক্রিয়া ব্যবহার করে। ভূ-তাপীয় তাপমাত্রা যখন ১০০ ডিগ্রি থেকে ১৮০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে থাকে, তখন এই ধরনের বাইনারি সাইকেল বা দ্বৈত চক্র বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন করা হয়। মাটির নীচ থেকে জল উত্তোলন করে সেই তাপ হিট-এক্সচেঞ্জারের মাধ্যমে সঞ্চালিত হয় এক জৈব তরলে যা অপেক্ষাকৃত কম তাপমাত্রায় বাষ্পীভূত হয়। এটি উচ্চ চাপের বাষ্পে রূপান্তরিত হয়ে টারবাইনকে চালিত করে যা সংযুক্ত জেনারেটরকে ঘুরিয়ে বিদ্যুৎ উৎপন্ন করে এবং এই জৈব তরল আবার হিট-এক্সচেঞ্জারে ফিরে আসে। পাইপের মধ্য দিয়ে যে জল মাটির উপরে উঠে হিট-এক্সচেঞ্জারের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়েছিল তা ঠান্ডা হয়ে আবার মাটির নীচে চলে যায় এবং এইভাবে চক্র আকারে জলের প্রবাহ চলতে থাকে। পাইপের জল পুনর্ব্যবহার করার জন্য কোন ক্ষয় হয় না। এবারে নিশ্চয়ই এই তিনটি পদ্ধতি সম্বন্ধে তোদের পরিষ্কার ধারণা হল।” এই বলে খুড়োর আবার চায়ের কাপে চুমুক।
ক্রমশ…