ভূ-তাপীয় শক্তি (অন্তিম পর্ব)
প্রথম পর্বের পর…..
সুবিমলের প্রশ্ন— “ভূগর্ভস্থ এই নির্দিষ্ট অঞ্চলগুলিতে, যেখানে পৃথিবীপৃষ্ঠের নীচে কার্যত সীমাহীন শক্তি এবং তাপ রয়েছে সেখানে কি যেকোন জায়গা থেকে এই ভূ-তাপীয় শক্তি ব্যবহার করা যায়?” খুড়োর জবাব “না, একেবারেই নয়— ‘হাইড্রোথার্মাল’ বা জলীয় তাপ সঞ্চালনকারী না হলে এটিকে শক্তি হিসাবে ব্যবহার করা সম্ভব নয়। এর অর্থ ভূগর্ভস্থ অঞ্চলগুলি কেবল উষ্ণ হলেই চলবে না, সেখানে বহনযোগ্য তরলও থাকতে হবে। অনেক অঞ্চলে এই সব কটি প্রয়োজনীয় উপাদান থাকে না। তখন শুকনো অঞ্চলে তরল সরবরাহের জন্য ড্রিলিং, ফ্র্যাকচারিং এবং ইনজেকশন; সব কটি প্রক্রিয়াই ব্যবহার করা হয়। উচ্চ-চাপ যুক্ত ঠান্ডা জল পাইপের মধ্য দিয়ে প্রবেশ করানো হয়, যা নীচের শিলাস্তরগুলিকে নতুনভাবে ভাঙতে এবং বিদ্যমান ফাটলগুলিকে প্রসারিত করতে সাহায্য করে, যার ফলে একটি ভূগর্ভস্থ জলাধার তৈরি হয়। সেখানে জল ভালভাবে ইনজেকশনের পাইপের মাধ্যমে পাম্প করা হয় এবং সেই জল শিলাগুলির তাপ শোষণ করে। এই গরম জল বা ব্রাইন নীচের জলাধার থেকে প্রোডাকশন পাইপের মাধ্যমে আবার জৈব তরলকে তাপ সরবরাহ করার জন্য প্রস্তুত হয়ে উপরে উঠে আসে। বাইনারি সিস্টেমে জল কেবলমাত্র হিটিং এজেন্ট হিসাবে ব্যবহৃত হয় এবং এটি বাষ্পীভূত হয় না, এটি পুনর্ব্যবহারযোগ্য।”
খুড়োর সংযোজন— “জেনে রাখ হট স্প্রিং বা উষ্ণ প্রস্রবণ এবং প্রাকৃতিক গিজারগুলি কিন্তু ভূ-তাপীয় শক্তি শোষণের জন্য একটি উপযুক্ত মাধ্যম।
প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে যেখানে সক্রিয় আগ্নেয়গিরির আধিক্য রয়েছে তাকে বলে অগ্নি রেখার বলয় বা ‘রিং অফ ফায়ার লাইনস’। ভূমিকম্প এবং আগ্নেয়গিরির সর্বাধিক সক্রিয়তা আমরা প্রধানত লক্ষ্য করি এখানকার টেকটোনিক প্লেটের সীমানা বরাবর। এই ‘রিং অফ ফায়ার’ ফিলিপিন্স এবং নিউজিল্যান্ডের পাশাপাশি ইন্দোনেশিয়া, জাপান এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মত বিস্তৃত অঞ্চল জুড়ে ছড়িয়ে আছে। এই অঞ্চলটি ভূমিকম্পপ্রবণ এবং বিশ্বের সক্রিয় এবং সুপ্ত আগ্নেয়গিরির আবাসস্থল। ‘রিং অফ ফায়ার’ হচ্ছে প্লেট টেকটোনিকস এবং লিথোস্ফেরিক প্লেটের আন্দোলন এবং সংঘর্ষের সরাসরি ফল যেখানে ভারী প্লেট হালকা প্লেটের নীচে পিছলে গিয়ে একটি গভীর ট্রেঞ্চ বা পরিখার সৃষ্টি করে। এই ভৌগলিক অপূর্ণতাই কিন্তু এই অঞ্চলকে দিয়েছে ভূ-তাপীয় শক্তির এক সম্ভাবনাময় সুযোগ।”
শুভাশিস এতক্ষণ মন দিয়ে শুনছিল, এবারে প্রশ্ন করে “বিদ্যুৎ উৎপাদন ছাড়া এই ভূ-তাপীয় শক্তি আর কোথায় কোথায় ব্যবহার হয়?” “এর প্রয়োগ আমরা প্রধানত লক্ষ্য করি শীতপ্রধান দেশে ঘর গরম রাখার জন্য, চাষবাসের প্রয়োজনে গ্রিনহাউস গরম রাখতে, সুইমিং পুল এবং পাবলিক স্নানাগার গরম রাখতে, বরফ গলানোর প্রয়োজনে ইত্যাদি। এছাড়া কৃষিপণ্য এবং মৎস্যজাতীয়পণ্য শুষ্ক করার কাজেও তা সর্বত্র ব্যবহৃত হয়। ভূ-তাপীয় শক্তির সবচেয়ে বড় সুবিধা হল বায়ুশক্তি এবং সৌরশক্তির মত অন্যান্য পুনর্নবীকরণযোগ্য শক্তির তুলনায় এটি একাধারে নির্ভরযোগ্য, মোটামুটি দূষণহীন ও সহজলভ্য শক্তির উৎস।” সুনীল প্রশ্ন করে— “আচ্ছা খুড়ো, উষ্ণ প্রস্রবণের জলে তো শুনেছি মিথেন, হাইড্রোজেন সালফাইড ইত্যাদি গ্যাসগুলি থাকে। তা থেকে দূষন হয় না?” “ হ্যা, এই সব গ্যাসগুলি বের হয় বটে, তবে তা পরিমাণে কম। তবে এই প্রক্রিয়ায় মিথেন ছাড়াও কিছু গ্রীনহাউস গ্যাস যেমন কার্বন ডাই অক্সাইড, নাইট্রাস অক্সাইড ইত্যাদিও নির্গত হয়। খনিজ ও ভারী ধাতু যেমন পারদ, আর্সেনিক, অ্যান্টিমনি ইত্যাদি পরিবেশে ছড়িয়ে যাওয়ার ঝুঁকি রয়েছে” খুড়োর জবাব।
“তবে ভূ-তাপীয় বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলির বেশ কতগুলি সুবিধাও আছে। প্রাথমিক ব্যয় বেশি হলেও দীর্ঘমেয়াদী হিসেবে তা লাভজনক। বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলি স্থাপনের জন্য প্রয়োজনীয় জমি ও পরিকাঠামোগত সম্পদগুলি তেল ও গ্যাস খনন, পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন ইত্যাদির তুলনায় তুলনামূলকভাবে সস্তা। ভূ-তাপীয় বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলি অন্যান্য বিদ্যুৎ কেন্দ্রের তুলনায় অনেক বেশি সুসংহত। একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ বিদ্যুৎশক্তি উৎপাদন করতে, একটি ভূ-তাপীয় বিদ্যুৎ কেন্দ্রের যে জমির প্রয়োজন হয়, প্রায় একই পরিমান বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে, বায়ুশক্তি কেন্দ্রের প্রয়োজন হয় প্রায় তিনগুণ বেশি জমি, সৌর ফটোভোলটাইক সেন্টারের জন্য প্রয়োজন হয় প্রায় ৮ গুণ জমি, এবং কয়লা নির্ভর বিদ্যুৎ কেন্দ্র তৈরি করতে লাগে প্রায় ৯ গুণ জমি। তাহলে বুঝতে পারছিস কম জায়গায় পুনর্নবীকরণযোগ্য প্রাকৃতিক শক্তির সাহায্যে প্রায় দূষণ মুক্ত বিদ্যুৎ উৎপাদনের সম্ভাবনা নিহিত আছে এই জিওথার্মাল পাওয়ার প্লান্টগুলিতে। তাছাড়া বিদ্যুৎ এবং জ্বালানীর ক্ষেত্রে প্ল্যান্টগুলি মোটামুটি স্বয়ংসম্পূর্ণ। সৌর বা বায়ুশক্তির মত ভূ-তাপীয়শক্তি ঋতু পরিবর্তনের উপর নির্ভরশীল নয় এবং এই শক্তি সারা বছর সমান ভাবে পাওয়া যায়”— এই বলে খুড়ো একটু থামেন।
এই প্রসঙ্গে খুড়োর একটি প্রশ্ন সবাইকে উদ্দেশ্য করে, “তোদের মধ্যে কেউ বলতে পারবি ভারতে পুনর্নবীকরণযোগ্য শক্তির লক্ষ্যমাত্রা কত ধরা হয়েছে?” সুবিমল বলে ওঠে— “২০২২ সালের মধ্যে ১৭৫ গিগাওয়াট এবং ২০৩০ সালের মধ্যে ৪৫০ গিগাওয়াট। এই তো সেদিন খবরের কাগজে দেখলাম। তবে এই ক্ষমতা কিন্তু সর্বাধিক ইন্সটল ক্যাপাসিটি বা সম্মিলিত উৎপাদন ক্ষমতা; কতটা তারা বাস্তবে উৎপাদন করছে তার পরিমাণ নয়।” “সরকারি পরিসংখ্যান অনুসারে, ২০২০ সালের জানুয়ারির শেষে ভারতে বিদ্যুৎ শক্তির সম্মিলিত উৎপাদন ক্ষমতা ৩৭০ গিগাওয়াটের কাছাকাছি ছিল। এর মধ্যে পুনর্নবীকরণযোগ্য ছোট জলবিদ্যুৎ, বায়ু, সৌর এবং জৈব শক্তিগুলির অবদান ছিল প্রায় ৯০ গিগা ওয়াট। কাজেই বুঝতে পারছিস যে ২০২২ সালের মধ্যে ভারতের পুনর্নবীকরণযোগ্য শক্তির পরিমাণ ৯০ গিগাওয়াট থেকে বৃদ্ধি করে ১৭৫ গিগাওয়াটে উন্নীত করা দৃশ্যতই এক চ্যালেঞ্জ। আর সেই চ্যালেঞ্জ-এর সামনে পড়ে অন্যান্য শক্তির সঙ্গে এই ভূ-তাপীয় শক্তির এবং টাইডাল বা জোয়ার ভাঁটা জাত শক্তির সার্থক রূপায়নের কথা হয়ত শীঘ্রই ভাবতে হবে আমাদের” খুড়োর সংযোজন।
খুড়ো বলেন— “জানিস, প্রধানত বিশ্বের শীতপ্রধান জায়গাগুলিতে ভূ-তাপীয় তাপশক্তি সোজাসুজি মাটির নীচ থেকে সংগ্রহ করে তাৎক্ষণিক উত্তাপের উৎস হিসাবে ব্যবহার করা হয়। এই তাপশক্তিকে নিম্ন-তাপমাত্রার ভূ-তাপীয় শক্তি বলা হয়, যা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে মাটি থেকে কয়েক মিটার নীচে পাওয়া যায়।
জিওথার্মাল হিট পাম্প (জিএইচপি) বা ভূ-তাপীয় তাপ-পাম্পগুলিকে কার্যকর করার জন্য প্রায় ১০ থেকে ৩০০ ফুট গভীর ড্রিল করা হয়, যা বেশিরভাগ তেল এবং প্রাকৃতিক গ্যাস কূপের চেয়ে অনেক অগভীর। জিএইচপির সাথে যুক্ত একটি পাইপ অবিচ্ছিন্ন লুপ বা বর্তনীর আকারে উপর থেকে নীচ পর্যন্ত সংস্থাপিত থাকে— যা হিট এক্সচেঞ্জারের কাজ করে। এই লুপটি যে বস্তুকে গরম বা ঠান্ডা রাখতে হবে তার সাথে সরাসরি যুক্ত থাকে। এই সিস্টেমে পাম্পের সাহায্যে জল বা অন্য তরল পাইপটির মধ্য দিয়ে যায়। শীতের সময়ে তরলটি ভূগর্ভস্থ তাপ শুষে নেয় এবং তাপকে উর্ধ্বমুখী করে লুপের মাধ্যমে উষ্ণতা দেয়। এই উত্তপ্ত পাইপ গরম জলের ট্যাঙ্কের মধ্যে চালিয়েও জল গরম করা যায়। গরমের সময় উল্টো ব্যাপারটা ঘটে পাইপের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত তরল বাড়ীর ভেতরকার উত্তাপে গরম হয় এবং ঠান্ডা হওয়ার জন্য ভূগর্ভস্থ স্তরে বহন করে নিয়ে যায়।”
সুনীলের মন্তব্য— “এ তো দেখছি মজার ব্যাপার— একাধারে এয়ারকন্ডিশনার, ঘর এবং জল গরম করার ব্যবস্থা— এবং পুরোটাই বিদ্যুত বা গ্যাসের জন্য এক পয়সা খরচ না করেই, শুধু জিএইচপি বসাবার প্রাথমিক খরচ ছাড়া। একটা ব্যাপার শুধু বুঝিয়ে বল, একই পাইপের মধ্য দিয়ে জল বা অন্য তরল যা প্রবাহিত হচ্ছে তা বিভিন্ন ঋতুতে কীকরে ঘরকে কখনো গরম বা কখনো ঠান্ডা রাখছে।” খুড়ো বোঝাবার চেষ্টা করেন, “বলছি মন দিয়ে শোন। এই ব্যবস্থা কিন্তু কেবল ঠাণ্ডার জায়গায় উপযোগী; উষ্ণ পরিবেশে নয়। একটা উদাহরণ দিয়ে বোঝাচ্ছি— কোনও শীতপ্রধান দেশে শীতকালে যখন তাপমাত্রা মাইনাস ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস, তখন ঘর গরম রাখতে হবে আর গরম কালে যখন তাপমাত্রা ৩২ ডিগ্রি সেলসিয়াস তখন ঘর ঠান্ডা রাখতে হবে। আমরা জানি যে শীত গ্রীষ্ম নির্বিশেষে মাটির তলায় তাপমাত্রা একই থাকে। ধর এ ক্ষেত্রে তা ১২ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এবারে শীতকালে ১২ ডিগ্রি তাপমাত্রায় জল প্রবাহিত হয়ে পরিবহনের মাধ্যমে ঘরের তাপমাত্রা মাইনাস ৪ ডিগ্রি থেকে বাড়িয়ে তা উপরে তুলে দেয়। আবার সেই একই জল গরমকালে ঘরের তাপমাত্রা ৩২ ডিগ্রি থেকে কমিয়ে তা নীচে নামিয়ে দেয়। এবারে তাপমাত্রা কতটা বাড়বে বা কতটা কমবে তা তোকে অঙ্ক কষে বের করতে হবে।” সুনীল বলে “হ্যাঁ বুঝতে পেরেছি, পদার্থবিদ্যার তাপবিজ্ঞান পড়ার সময় এসব অঙ্ক আমরা করেছি।”
গ্রীনহাউসগুলিতে, ফিশারি এবং শিল্প প্রক্রিয়ায় গরম করার জন্য এবং হট স্প্রিং স্পাগুলিতে নিম্ন-তাপমাত্রার ভূ-তাপীয় শক্তি ব্যবহার করা হয়ে থাকে। এছাড়া বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য এর ব্যবহার তো আছেই। শীতের দেশে অনেক শহরে নিম্ন-তাপমাত্রার ভূ-তাপীয় শক্তি বাড়ী এবং ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানগুলিকে গরম রাখার জন্য সরবরাহ করা হয়। মার্কিন পরিবেশ সংস্থার মতে ভূ-তাপীয় শক্তির মাধ্যমে তাপ সঞ্চালন ব্যবস্থা সর্বাধিক এনার্জি এফিসিয়েন্ট বা শক্তি-দক্ষ এবং পরিবেশগতভাবে নিরাপদে উষ্ণ এবং শীতল রাখার সবচেয়ে ভালো ব্যবস্থা। তবে আবহাওয়া জনিত কারণে এই ব্যবস্থা আমাদের দেশের মত গ্রীষ্মপ্রধান দেশের বেশির ভাগ জায়গাতেই কার্যকর হবেনা।
————————
~ কলমে এলেবেলের অতিথি দেবাশীষ দাশগুপ্ত ~
দেবাশীষ একজন অবসরপ্রাপ্ত প্রযুক্তিবিদ
► এলেবেলেকে ফলো করুন।