কোভিশিল্ড ও কোভ্যাকসিন

প্রিয়জনদের শেয়ার করুন
1,047 বার লেখাটি পঠিত হয়েছে ~~~

পৃথিবীতে দেড় বছর হয়ে গেল SARS-COV2 করোনা ভাইরাস আর COVID-19 -র। এই দেড় বছরে প্রায় আঠেরো কোটি মানুষ সংক্রমিত হয়েছেন, আর মৃত্যু হয়েছে প্রায় চল্লিশ লক্ষ মানুষের। এর মধ্যে প্রচুর দ্বিধাদ্বন্দ্ব, ষড়যন্ত্রতত্ত্ব ইত্যাদি পেরিয়ে বাজারে একাধিক ভ্যাকসিন এসেছে। ভারতে আপাতত ব্যবহৃত হচ্ছে, অক্সফোর্ড-অ্যাস্টাজেনিকার সহযোগে ভারতের সিরাম ইন্সটিটিউটের কোভিশিল্ড ভ্যাকসিন আর অন্যটি হল পুনের ন্যাশেনাল ইন্সটিটিউট অফ ভাইরোলজি-র সহযোগিতায় তৈরি ভারত বায়োটেকের কোভ্যাকসিন। এবার এই দুটি আলাদা ভ্যাকসিন কি ভাবে একই কাজ করে?

যখন কোন জীবাণু আমাদের দেহে আক্রমণ করে, তখন আমাদের শরীর পূর্ব অভিজ্ঞতা ছাড়াই যে প্রতিরোধ গড়ে তোলে, তাকে বলে সহজাত অনাক্রম্যতা। আর একবার কোন জীবাণু আমাদের দেহে আক্রমণ করলে সেই অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে আমরা যে অনাক্রম্যতা অর্জন করি, তাকে বলে অর্জিত অনাক্রম্যতা।

কি করে কাজ করে জানার আগে, আমাদের একটু অনাক্রম্যতা বা immunity সম্বন্ধে আলোচনা করতে হবে। অনাক্রম্যতা হল গিয়ে দুরকমের— সহজাত আর অর্জিত। যখন কোন জীবাণু (সে ভাইরাস বা ব্যাকটিরিয়া যাই হোক না কেন) আমাদের দেহে আক্রমণ করে, তখন আমাদের শরীর পূর্ব অভিজ্ঞতা ছাড়াই যে প্রতিরোধ গড়ে তোলে, তাকে বলে সহজাত অনাক্রম্যতা (Innate immunity)। আর একবার কোন জীবাণু আমাদের দেহে আক্রমণ করলে সেই অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে আমরা যে অনাক্রম্যতা অর্জন করি, তাকে বলে অর্জিত অনাক্রম্যতা (Acquired immunity)। এই অর্জিত অনাক্রম্যতার গল্পটা একদম মার কাটারি সত্তরের ধুম-ধারাক্কা হিন্দি সিনেমার মত। অ্যাকশান, আত্মত্যাগ আর প্রতিশোধের এই জমজমাট কাহিনীতে নায়ক দুজন— B-কোষ আর T-কোষ। ‘দুর্ধষ দুশমন’ হল যে কোন ভাইরাস বা ব্যাকটিরিয়া। এবারের দুশমন হল SARS-COV-2 করোনা ভাইরাস।

করোনা ফুসুফুসের দখল নিতে এসেছে। আর যখন তাদের আমাদের সহজাত অনাক্রম্যতার সাথে প্রবল যুদ্ধ হচ্ছে, তখন করোনাকে বধ করার উদ্দেশ্যে দেহে দুই নায়ক B-কোষ আর T-কোষের জন্ম হয়। কিন্তু তারা তখন বড়ই ছোট (immature)। তারা বড় হতে থাকে, কিন্তু সময় লেগে যায়। তাই কিছু করে উঠতে পারেনা। কিন্তু প্রতিজ্ঞা করে, আবার যদি এই দুশমনের সাথে দেখা হয়, তারা এই দুশমনকে নিকেশ করে প্রতিশোধ নেবেই নেবে! তারা দুশমনের বিভিন্ন অংশ (বিশেষতঃ প্রোটিন অংশ) নিজেদের স্মৃতিতে রেখে দেয়, যাদের বলে অ্যান্টিজেন। এই বিভিন্ন অ্যান্টিজেনের বিরুদ্ধে B-কোষেরা ভবিষ্যতে তৈরি করবে বিভিন্ন অ্যান্টিবডি। অ্যান্টিবডিও হল এক বিশেষ শ্রেণীর প্রোটিন। প্রথম বার আক্রমণে অ্যান্টিবডি তৈরিতে প্রায় দু-তিন সপ্তাহ লেগে যায় বলে আক্রান্তের তা খুব একটা কাজ দেয়না। যদিও পরের কয়েক সপ্তাহ সেই অ্যান্টিবডি রক্তে থেকে যায়। রক্ত পরীক্ষায় এই অ্যান্টিবডি তখন ধরা পড়ে, এমনকি রোগলক্ষণহীন Asymptomatic দের রক্তেও। ফলে  Asymptomatic -র ক্ষেত্রেও বোঝা যায়, তারা সংক্রামিত হয়েছিল। একে ‘অ্যান্টিবডি টেস্টিং’ বলে। উপযাচক হয়ে আগে ভাগে টেস্ট করলে কিন্তু ধরা পড়বেনা, কারণ প্রথমবার অ্যান্টিবডি তৈরি হতে সময় লাগে। এসময় দ্বিতীয়বার সংক্রমণ হলে রক্তে উপস্থিত অ্যান্টিবডিই করোনাকে নিকেশ করে ফেলবে। তবে করোনার ক্ষেত্রে এই অ্যান্টিবডির আয়ু বেশদিন না, মাস ছয়েক। তবে তাতে চিন্তার কিছু নেই, কারণ যখন করোনা দ্বিতীয়বার  আক্রমণ করে, তখন  B-কোষেদের করোনাকে দেখেই পুরনো কথা মনে পড়ে যায়।  তারা রাগে ফুঁসে ওঠে। B-কোষ তখন আর সপ্তাহ নয়, দিন দুয়েকের মধ্যে প্রচুর পরিমাণে অ্যান্টিবডি তৈরি করে ফেলে। এই মহাস্ত্র অ্যান্টিবডি সে একমাত্র করোনাকে মারার জন্যেই তৈরি করেছে স্মৃতি থেকে। অ্যান্টিবডি এসে করোনা ভাইরাসদের ঘিরে ধরে নিষ্ক্রিয় করে বা শ্বেত রক্তকণিকা ডেকে খাইয়ে দেয়। এর মধ্যে কিছু ভাইরাস আবার অ্যান্টিবডির নজর এড়িয়ে কিছু কোষে সংক্রমণ করেও ফেলে। তখন সেই আক্রান্ত কোষেরা T-কোষদের ডাকে, তারা তাদের গায়ে করোনার প্রোটিনের টুকরো লেগে আছে দেখিয়ে দেয়। T-কোষ আবার ভাইরাসকে সরাসরি চিনতে পারেনা। সে খালি চিনতে পারে কোষের গায়ে লেগে থাকা ভাইরাসের প্রোটিনের টুকরো। T-কোষ বিনা বাক্যব্যয়ে আক্রান্ত কোষগুলোকে মেরে ফেলে। ফলে তার সাথে ভাইরাসও খতম  হয়ে যায়। এভাবেই সারা জীবনে এরপর যতবার দেহে করোনার প্রাদুর্ভাব হবে, তাদের বিনাশার্থে B-কোষ আর T-কোষ এই ভাবেই অবতীর্ণ হবে রক্তে। যে কোন জীবাণুর ক্ষেত্রেই এই গল্প প্রযোজ্য। কারণ B-কোষে বিভিন্ন জীবাণুর বিরুদ্ধে বিভিন্ন রকমের লাখ লাখ রকমের অ্যান্টিবডি তৈরি করার সংকেত থাকে। কিন্তু যদি পরের বার করোনা mutate করে নিজের রূপ বদলে আসে, তখন তাকে B-কোষ আর T-কোষ চিনতে না পারার একটা আশঙ্কা থেকে যায়।

গোটা জ্যান্ত জীবাণু যেমন অর্জিত অনাক্রম্যতা তৈরি করে, সেরকমই মরা জীবাণু, জ্যান্ত কিন্তু নির্বিষ জীবাণু বা জীবাণুর কোন প্রোটিনও তা তৈরি করতে পারে। তাই সেগুলোই আমাদের দেহে ভ্যাকসিন হিসেবে ব্যবহার করা হয়।

এবার ‘এই দুষ্টের দমন, শিষ্টের পালনে’র গল্পে ভ্যাকসিন গেল কোথায়? সেখানেই তো কাহিনীতে মোচড়। গোটা জ্যান্ত জীবাণু যেমন অর্জিত অনাক্রম্যতা তৈরি করে, সেরকমই মরা জীবাণু, জ্যান্ত কিন্তু নির্বিষ জীবাণু বা জীবাণুর কোন প্রোটিনও তা তৈরি করতে পারে। তাই সেগুলোই আমাদের দেহে ভ্যাকসিন হিসেবে ব্যবহার করা হয়। B-কোষ আর T-কোষ ভ্যাকসিনকে আসল জীবাণু ভেবে চিনে রাখে, পরে দেহে যদি আসল জীবাণুর আক্রমণ হয়, ভ্যাকসিনের স্মৃতি থেকেই তারা সক্রিয় হয়ে জীবাণুদের মেরে ফেলে। অর্থাৎ ভ্যাকসিনে অর্জিত অনাক্রম্যতার মজাটা আছে, কিন্তু সংক্রমণের সাজা নেই।

করোনার কোভিশিল্ড ভ্যাকসিনে অ্যান্টিজেন হিসেবে ব্যবহৃত হয় SARS-COV-2 করোনা ভাইরাসের কাঁটা (Spike) প্রোটিনটি। যে কাঁটা-প্রোটিন দিয়ে করোনা মানুষের কোষ আঁকড়ে ধরছে। বিজ্ঞানীরা শান্তশিষ্ট ভদ্র একটি অ্যাডেনো ভাইরাস নিয়ে তার DNA তে কাঁটা-প্রোটিনের DNA জুড়ে দিয়েছেন। এই অ্যাডেনো ভাইরাস শিম্পাঞ্জিতে একটু সর্দিই ঘটাতে পারে মাত্র। তাও অ্যাডেনো ভাইরাসকে বিজ্ঞানীরা একেবারে নিষ্ক্রিয় করে দিয়েছেন, সে মানুষের দেহে নিজের সংখ্যা বাড়াতেই পারবেনা, যে কটা ভাইরাস কণা ঢোকানো হবে সেই কটিই থাকবে। কিন্তু এরা মানুষের কোষে করোনার কাঁটা-প্রোটিনটি তৈরি করতে পারবে। অর্থাৎ বিজ্ঞানীরা নির্বল ভদ্র বেচারা মতন একটা ভাইরাসকে কাঁটার মুকুট পরিয়ে করোনা সাজিয়ে পাঠাচ্ছেন কোষে। B-কোষ এই কাঁটা-প্রোটিনকে অ্যান্টিজেন হিসেবে চিনে রাখবে, তারপর আসল করোনা এলেই B-কোষ তার কাঁটা-প্রোটিন চিনে ফেলে নির্দিষ্ট অ্যান্টিবডি তৈরি করবে। আর বেশি ট্যাঁফোঁ করার আগেই সেই অ্যান্টিবডি এসে করোনার দফা সারা করবে। প্রসঙ্গত, রাশিয়ার স্পুটনিক ভ্যাকসিনও প্রায় একই রকম প্রযুক্তিতে তৈরি।

এবার আসি কোভ্যাকসিনের কথায়। আগেই বললাম, মরা জীবাণু, জ্যান্ত কিন্তু নির্বিষ জীবাণুও আমাদের দেহে ভ্যাকসিন হিসেবে ব্যবহার করা যায়। কোভ্যাকসিন হল সেই মরা বা নিষ্ক্রিয় করোনা ভাইরাস। ১৯৫০-র দশকে পোলিও ভাইরাসের ক্ষেত্রে মরা ভাইরাসকে ভ্যাকসিন হিসেবে প্রথম ব্যবহার করেছিলেন বিজ্ঞানী জোনাস সলক্‌; অ্যামেরিকায়। তিনি বাঁদরের বৃক্ক বা কিডনি কোষ কৃত্রিম ভাবে পালন করে, সেগুলোতে পোলিও ভাইরাস সংক্রমণ করেন। পোলিও ভাইরাস ওই কোষগুলোতে সংখ্যাবৃদ্ধি করতে থাকে। এভাবে তিনি কৃত্রিম ভাবে প্রচুর পরিমাণে পোলিও ভাইরাস তৈরি করেছিলেন। তারপর সেই ভাইরাসগুলোকে ফর্মালিন দিয়ে নিষ্ক্রিয় করে ফেলেন। ফর্মালিনের বৈশিষ্ট্য হল, ফর্মালিন কোষ বা ভাইরাসকে মেরে ফেললেও, কোষের বা ভাইরাসের মূল গঠন বিকৃত করেনা। তাই পোলিও ভাইরাস কণার গঠন সেরকমই রইল, খালি তারা নিষ্ক্রিয় হয়ে গেল! এই নতুন পদ্ধতির ভ্যাকসিনের সাফল্যে শুরু হয় ভ্যাকসিনের নতুন এক অধ্যায়। জোনাস সলক এই পদ্ধতিতেই তৈরি হয়েছে কোভ্যাকসিন। সংক্রামিতের থেকে SARS-COV-2 করোনা ভাইরাসকে উদ্ধার করে বাঁদরের বৃক্ক বা কিডনি কোষ ব্যবহার করে প্রথমে কৃত্রিম ভাবে করোনা ভাইরাস তৈরি করা হয়েছে। সেই ভাইরাসকে বিজ্ঞানীরা নিষ্ক্রিয় করেছেন ফর্মালিনের বদলে বিটা-প্রোপিওল্যাকটোন নামে একটি রাসায়নিক দিয়ে, যা আজকাল এই নিষ্ক্রিয় ভ্যাক্সিন বানাতে বহুল ব্যবহৃত। এই নিষ্ক্রিয় করোনা ভাইরাসই হল কোভ্যাকসিন। কোভিশিল্ড আর কোভ্যাকসিন দুটিরই কার্য্যকারিতা ৭০%-র কাছাকাছি। তাই কোনটি বেশি ভাল, তা এই মুহুর্তে বলা সম্ভব না। তাই সেক্ষেত্রে যেটি পাওয়া যাচ্ছে, সেটিই নেওয়া যেতে পারে।

 ——————————————

~ কলমে এলেবেলে নির্মাল্য ~

এলেবেলের দলবল

► লেখা ভাল লাগলে অবশ্যই লাইক করুন, কমেন্ট করুন, আর সকলের সাথে শেয়ার করে সকলকে পড়ার সুযোগ করে দিন। 

► এলেবেলেকে ফলো করুন। 

 

 

 

 

 

3 thoughts on “কোভিশিল্ড ও কোভ্যাকসিন

  • June 23, 2021 at 6:18 am
    Permalink

    অসাধারণ. আপনার informative লেখা পড়ে খুব ভালো লাগলো.
    অসংখ্য ধান্যবাদ
    Dr অশোক কুমার মুখোপাধ্যায়
    কোলকাতা

  • June 28, 2021 at 7:33 am
    Permalink

    ধন্যবাদ, Dr মুখোপাধ্যায়। সাথে থাকবেন এলেবেলের। – নির্মাল্য

  • July 12, 2021 at 3:23 am
    Permalink

    খুব তথ্য যুক্ত লেখা। সহজ ভাষা। ভাল লাগল।

Leave a Reply

free hit counter
error

লেখা ভালো লেগে থাকলে দয়া করে শেয়ার করবেন।