জ্যোতিষ ও জ্যোতির্বিজ্ঞান
~ কলমে অরিত্র দাস ~
প্রথমেই একটা প্রশ্ন করে রাখি পাঠকদের জন্য। যার উত্তর দেওয়ার জন্যই এটা লেখা।
জ্যোতিষ ও জ্যোতির্বিজ্ঞান উভয়ের ঠিক কাজটা কি এই মুহূর্তে মানব সভ্যতার জন্য? মানে ঠিক কি কারণে এদের ব্যবহার হয়?
এবার আসি মূল প্রসঙ্গে।
রাতের আকাশে সব সাদা স্থির বিন্দুই তারা। তারা ছাড়াও কিছু নক্ষএপুঞ্জও থাকে, কিন্তু এই গল্পে তাদের অবদান নেই বললেই চলে।
প্রাচীনকাল থেকেই মানুষ প্রাকৃতিক ঘটনাবলী যেমন বিদ্যুৎ চমকানো, ভূমিকম্প ইত্যাদির কারণ খুঁজতে উপরে তাকিয়েছে, এবং সেই মুহূর্তের তারাদের মধ্যেই উত্তর খুঁজেছে। আসলে দিনের আলো নেভার পর তাদের বিশেষ কিছু কাজ না থাকার জন্যই মূলত তারা আকাশে তাকাতো এবং সেই সুবিশাল আকাশের সাদা বিন্দুরূপী তারাদের দেখে বিভিন্ন নকশা বানাতো বিন্দুগুলোকে কাল্পনিক রেখা দিয়ে যোগ করে। তারা নিজেদের গল্পগাথাকে আশ্রয় করেই মূলত এই নকশাগুলো বানাতো; যে কারণে বিভিন্ন সভ্যতায় একই রকম দেখতে নকশাগুলোও আলাদা গল্প বহন করে। উদাহরণ হিসেবে, আজ যে নক্ষত্রমন্ডলীকে ভারতীয় সভ্যতায় কালপুরুষ বলি তাই পশ্চিমি সভ্যতায় শিকারি যোদ্ধা যাকে স্বয়ং জিউস তারাদের মধ্যে প্রেরণ করেছিল। এখন একটা ভৌগোলিক সমস্যায় আসি। যেটাকে আমরা আকাশ বলি, বিজ্ঞানের ভাষায় সেটা হলো খ–গোলক। ধরে নিন, গোলাকার পৃথিবী আরো একটা বড় গোলাকার বলের কেন্দ্র বিন্দুতে বসে আছে। এবং সেই বড় বলের মধ্যেই সাদা কালি দিয়ে তারাগুলো আঁকা আছে। পৃথিবীর অক্ষাংশ রেখাগুলোকে যদি বাড়িয়ে খ–গোলক অবধি নিয়ে যাওয়া যায়, তাহলে খ–গোলকেরও একটা নিরক্ষরেখা ও অক্ষরেখা পাবো, যা পৃথিবীর সাথে এক হবে। ঠিক সেরকম ভাবেই খ–গোলকে দ্রাখিমারেখাও পাবো। যেহেতু পৃথিবী মূলত গোলাকার তাই ভূপৃষ্ঠে অবস্থান করার জন্য আমরা সমগ্র গোলকটা কখনোই দেখতে পাই না। একটা উদাহরণ দিই, কাঁচড়াপাড়ার অক্ষাংশ হলো ২২ ডিগ্রি উত্তর, তো আমরা খ–গোলকের ৯০ ডিগ্রি উত্তর অক্ষাংশ থেকে ৭৮ ডিগ্রি দক্ষিণ অক্ষাংশ অবধিই কেবল দেখতে পাবো। যদি আরো উত্তরে যেতে থাকি তাহলে দক্ষিণ অক্ষাংশ কমতে থাকবে। যেমন উত্তর মেরু থেকে (৯০ ডিগ্রি উত্তর) আমরা কোনদিনও নিরক্ষরেখার নিচের আকাশ দেখতে পাবো না। এবার যেহেতু মানব সভ্যতার বেশিরভাগটাই উত্তর গোলার্ধে কেটেছে, তাই স্বাভাবিকভাবে প্রাচীন সভ্যতার মানুষরা উত্তর গোলার্ধেই বেশি তারামণ্ডল বানিয়েছিলেন। গ্রিক টলেমি ৪৮ টা আলাদা তারামণ্ডলের নকশা দিয়ে গেছিলেন যাতে খুব বেশি দক্ষিণ গোলার্ধ ছিল না।
তারামণ্ডলরূপী কাল্পনিক ব্যাপারটা বোঝার পর এবার যাবো জ্যোতিষ–এ। ভারতীয়রা এ ব্যাপারে একচেটিয়া নয় কিন্তু। আসলে তারারা ছিল স্থির। সমস্যা করতো যারা ঘুরে বেড়াতো। তার মধ্যে মূল ছিল সূর্য আর চন্দ্র। আরো ছিল, যেমন শুক্রগ্রহ, যা শুকতারা বা সন্ধ্যাতারা হিসাবে গুরুত্বপূর্ণ ছিল। আসলে এদের গুরুত্বটা ছিল মূলত সময়কে বোঝার জন্য। পূব আকাশে সন্ধ্যাতারা বা পশ্চিম আকাশে শুকতারা বিভিন্ন মৌসম–এর বার্তা দিত। তো সেই সময়ে এদের গুরুত্ব অপরিসীম ছিল। ঘড়ি না থাকার কারণে মানুষকে তাদের যাত্রার সময়, ফসল বোনা, কাটা ইত্যাদির জন্য নির্ভর করতে হতো এদের উপরেই।
গল্পের মূল হলো সূর্য। পৃথিবী সূর্যের চারিদিকে যে পাক খায় সেই কক্ষপথ কিন্তু একটা বিশেষ কোণে হেলে থাকে। পৃথিবী নিজের অক্ষের উপরও হেলে থাকে। কিন্তু এটা সেটা না। পৃথিবীর কক্ষপথ ২৩.৫ ডিগ্রি কোণে সূর্যের উপর হেলে থাকে। মানেটা হলো, খ–গোলকে সূর্য নিরক্ষরেখার উপর দিয়ে যায় না। একটা সাইন–কার্ভ–এর উপর দিয়ে যায়। যার সর্বোচ্চ বিন্দু থাকে ২৩.৫ ডিগ্রি উত্তর অক্ষাংশে, সর্বনিন্ম বিন্দু থাকে ২৩.৫ ডিগ্রি দক্ষিণ অক্ষাংশে। নিরক্ষরেখাকে দুবার ছেদ করে। উত্তর অক্ষাংশ–এর এই সর্বোচ্চ বিন্দুই হলো কর্কট সংক্রান্তি (উত্তর অয়নান্ত বিন্দু) ও দক্ষিণ অক্ষাংশ–এর সর্বনিম্ন বিন্দু হলো মকর সংক্রান্তি (দক্ষিণ অয়নান্ত বিন্দু)। আবার নিরক্ষরেখার ছেদ বিন্দু দুটো হলো মহা বিষুব ও জল বিষুব।
এবার এই যে খ–গোলকে সূর্যের আপাত কক্ষপথ তাকে আমরা বলি ইক্লিপটিক বা অয়নবৃত্ত। এই রেখাটাই যে যে তারামণ্ডলের উপর দিয়ে গেছে তাদেরই বলে জোডিআক বা সৌরচিহ্ন।
পৃথিবীর সব প্রাচীন ধর্মেই এই তারামণ্ডলের সংখ্যা ১২ টা। কিন্তু সবার যে তারামণ্ডলের ম্যাপ আছে সেখানে সূর্য ১৩ টার উপর দিয়ে যায়, ১২ টা না। ভারতীয় হিসাবে সেই ১৩ নম্বরটি হলো সর্পধারী, যার প্রাচীনতার উল্লেখও পাওয়া যায়। মূলত ১৩ সংখ্যাটি অবিভাজ্য হওয়ার জন্যই সর্পধারীর এই বঞ্চনা। এর পাশ্চাত্য নাম অফিউকাস।
বর্তমান হিসাবে খ–গোলকে ৮৮ টা তারামণ্ডলী আছে, মানে খ–গোলককে ৮৮ টা ভাগে ভাগ করা আছে।
এবার এই যে খ–গোলকে সূর্যের আপাত কক্ষপথ তাকে আমরা বলি ইক্লিপটিক বা অয়নবৃত্ত। এই রেখাটাই যে যে তারামণ্ডলের উপর দিয়ে গেছে তাদেরই বলে জোডিআক বা সৌরচিহ্ন।
এবার আসি সবার উপরের প্রশ্নে, দরকার টা কি??
বিজ্ঞানে এর দরকার হলো নতুন কোনো মহাজাগতিক ঘটনার অবস্থান নির্দেশ করার জন্য। আকাশে কোনো নতুন তারা জন্ম নিলে তাকে একটা ঠিকানা দেওয়াটাই এই ৮৮ টা তারামণ্ডলীর কাজ।
এবার আসি জ্যোতিষ–এ।
১। তারামণ্ডলী কোনো বাস্তব বস্তু না। কাল্পনিক রেখা দিয়ে প্রাচীনকালের মানুষ যাদের সূর্য ডোবার পরে কোনই কাজ ছিল না তাদের দ্বারা আঁকা বস্তু। তাই আপনার রাশি কুম্ভ হলেও তা আদতে কোনো কুম্ভ না, আপনি তার কোনো বিশেষত্ব বহন করেন না।
২। একটা তারামণ্ডলীতে অবস্থানকারী তারাগুলো পৃথিবী থেকে একই দূরত্বে নেই। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, কালপুরুষের যে বেল্ট আমরা দেখতে পাই তাতে যে মূল ৩টে তারা আছে তারা ১৩৪২, ৮১৭ ও ৯১৬ আলোকবর্ষ দূরে আছে। ব্যাখ্যা নিষ্প্রয়োজন। এবার ১৩৪২ আলোকবর্ষ মানে আলোর গতিতে চললেও যার আপনার কাছে পৌঁছাতে ১৩৪২ বছর লাগবে সে হিসেব করে আপনার জন্মের ঠিক ১৩৪২ বছর আগে বেরিয়ে আপনাকে উদ্ধার করবে এই কষ্টকল্পনাটা না করলেই হয়তো ভালো।
৩। সর্পধারীর অপমান মেনে না নেওয়াই উচিত। আপনি জ্যোতিষকে বিজ্ঞান বললে সর্পধারীর জন্য লড়াই করুন। বিজ্ঞানে সবাই গুরুত্বপূর্ণ।
৪। উত্তর গোলার্ধে থাকলে আপনি ৩টে রাশি দেখতেই পেতেন না সারাজীবনেও। এবার সেই রাশিতে জন্মালে কি হতো সেটা ভাবতেই ভয় লাগছে আমার।
৫। জ্যোতিষ–এর মূল কাজ আপনার নিরাপত্তাহীনতাকে পয়সায় পরিণত করা। তাই যদি হয় তাহলে ১৩৪৩ আলোকবর্ষ দূরের কোনো তারা আপনাকে নিরাপত্তা দিতে পারবে না।
XXX WRONG XXX
VOTE FOR OPHIUCHUS
লেখক পরিচিতি:
এলেবেলের অতিথি অরিত্র দাস (https://www.aritra.space)
সৌরকলঙ্ক ও পরিবর্তনশীল নক্ষত্র পর্যবেক্ষক: আমেরিকান অ্যাশোসিয়েসন অফ ভেরিয়াবেল স্টার অবজারভারস,
প্রতিষ্ঠাতা: জিওরদানো ব্রুনো অবজারভেটরী, কাঁচরাপাড়া।
পেশায়: বরিষ্ঠ বিভাগীয় প্রকৌশলী (যান্ত্রিক), পূর্ব রেলওয়ে কারখানা, কাঁচরাপাড়া।
চিত্রসূত্র:
প্রথম চিত্র: http://planetary-science.org/wp-content/uploads/2013/06/RADEC.png
দ্বিতীয় চিত্র: https://en.wikipedia.org/wiki/Orion_(constellation)#/media/File:Orion_(constellation)_Art.svg
তৃতীয় চিত্র: https://en.wikipedia.org/wiki/Orion_(constellation)#/media/File:Orion_Head_to_Toe.jpg
চতুর্থ চিত্র: https://en.wikipedia.org/wiki/Ecliptic#/media/File:Earths_orbit_and_ecliptic.PNG
পঞ্চম চিত্র: https://en.wikipedia.org/wiki/Constellation_family#/media/File:Constellations_ecliptic_equirectangular_plot.svg
ষষ্ঠ চিত্র: https://earthsky.org/astronomy-essentials/what-is-the-zodiac/
সপ্তম ছবি: ষষ্ঠ ছবিকে এডিট করে প্রাপ্ত।