ব্লাড ব্যাঙ্ক ও ব্লাড ট্রান্সফিউশন এর ইতিহাস
~ কলমে এলেবেলে দেবদীপ ~
‘ব্লাড ট্রান্সফিউশন‘ শব্দটির সঙ্গে আমরা আজকের যুগে কমবেশি প্রায় সকলেই পরিচিত। সহজ ভাষায় বলতে গেলে এটি হল একজনের শরীরে শিরাপথে রক্ত দ্রব্যসমূহকে প্রবেশ/স্থানান্তর করার প্রক্রিয়া।
ব্লাড ট্রান্সফিউশন মূলতঃ অস্ত্রোপচার বা আঘাতের মাধ্যমে অপব্যয়িত রক্তকে প্রতিস্থাপন করতে বা কারো শরীর সঠিকভাবে রক্ত তৈরিতে যখন অক্ষম হয়, তখন তাকে প্রদান করা হয়ে থাকে। এছাড়া রক্তাল্পতা, হিমোফিলিয়া ইত্যাদির মত রক্তপাত–জনিত অসুস্থতায় ব্লাড ট্রান্সফিউশনের প্রয়োজন লাগে।
এবার একটু টাইম-ট্রাভেল করা যাক। এক শতাব্দীরও কম সময় আগে, ‘ব্লাড ট্রান্সফিউশন‘ শব্দটি পুরোপুরি অচেনা না হলেও, যে সমস্ত রোগীদের তা প্রয়োজন হত, ব্যাপারটা তাদের জন্য তখন অনেকটা হয়ে দাঁড়াত সময়ের সঙ্গে বা বলা ভালো সময়ের বিপরীতে দৌড়েরই নামান্তর। রক্তদানের জন্য তখনও অবধি মানুষের কোন সংগঠিত নেটওয়ার্ক গড়ে ওঠেনি, এবং সর্বোপরি রক্ত সংরক্ষণ করা যেহেতু সেসময় খুবই কঠিন ছিল, তাই ভবিষ্যতে ব্যবহারের জন্য এটি সংরক্ষণ করার কোন উপায়ও ছিল অজানা। বেশি দেরী হয়ে যাওয়ার আগেই তাই রোগীদের নিজেদেরই রক্তদাতা খুঁজে বের করতে হত।
১০ দিন পর্যন্ত রক্ত সংরক্ষণের একটি কৌশল তৈরি করার পরে, ইহুদি–মার্কিন চিকিৎসক বার্নার্ড ফ্যান্টাস ১৯৩৭ সালের এক দুপুরে শিকাগো শহরের কুক কাউন্টি হাসপাতালে আমেরিকার প্রথম “ব্লাড ব্যাঙ্ক” স্থাপন করেন। সেই সময়ে তিনি ওই হাসপাতালেরই ফার্মাকোলজি এবং থেরাপিউটিক বিভাগের ডিরেক্টর পদে কর্মরত। ‘ব্লাড ব্যাঙ্ক‘ শব্দেরও প্রচলন ওই তখন থেকেই, লোকেরা ভবিষ্যতে তাদের নিজেদের ব্যবহারের জন্য বা সদৃশ রক্তের গ্রুপের অন্যদের দান করার কাজে তাদের নিজস্ব রক্তের আমানত করতে শুরু করেন সেখানে।
প্রায় একই সময়ে, সার্জন তথা গবেষক চার্লস রিচার্ড ড্রিউ রক্ত থেকে প্লাজমা আলাদা করার একটি পদ্ধতি বের করতে সমর্থ হন এবং দেখেন যে যদি পুরো রক্তের প্রয়োজন না হয়, তবে শুধুমাত্র প্লাজমা দিয়েই ব্লাড ট্রান্সফিউশন সফলভাবে করা যেতে পারে। আর এর ওপর সুবিধে হল— ব্লাড ব্যাঙ্কে প্লাজমার দীর্ঘমেয়াদী স্টোরেজ করে রাখা সম্ভব। বর্তমানে হিমায়িত প্লাজমাকে খুব কম তাপমাত্রায় (-২৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস) ১২ মাস অবধি সরক্ষন করে রাখা যায়।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ যখন ইউরোপের একটা বিস্তীর্ণ অংশকে ছারখার করে দিচ্ছিল, সেসময় ডঃ ড্রিউ, ডাক্তার জন স্কাডার এবং আমেরিকান রেড ক্রসের অনেক সদস্যরা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে দান করা ও সংগৃহীত প্লাজমা ব্রিটেনে পাঠানোর জন্য “ব্লাড ফর ব্রিটেন” নামের এক যুগান্তকারী প্রকল্প চালু করেন, যা রক্তদানের এক জাতীয় ব্যবস্থা হয়ে দাঁড়ায়, ইংল্যান্ডের সঙ্গে যদিও তখনও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডা প্রত্যক্ষভাবে যুদ্ধে যোগ দেয়নি। ব্রিটেনের জন্য ওই ব্লাড প্রজেক্টের উদ্দেশ্য ছিল আহত সৈন্যদের রক্ত দেওয়া। প্রোগ্রামটি পাঁচ মাস ধরে পরিচালিত হয়েছিল এবং ১৫,০০০ জনের কাছ থেকে অনুদান সংগ্রহ করেছিল। এর পরে, ডঃ ড্রিউ আমেরিকান রেড ক্রস ব্লাড ব্যাঙ্কের প্রথম পরিচালক হিসেবে নিযুক্ত হন।
যুদ্ধ চলাকালীন তাঁরা সবাই মিলে স্থাপন করে ফেলেন “ব্লাডমোবাইলস“— অর্থাৎ ভ্রাম্যমান রক্তদান কেন্দ্র যা ব্লাড ব্যাঙ্কগুলি টিকিয়ে রাখা ও তার কার্যকারিতাকে আরও বাস্তবসম্মত করে তোলে। আজ, প্রতি বছর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রায় ১৩.৬ মিলিয়ন ইউনিট সম্পূর্ণ রক্ত এবং লোহিত রক্তকণিকা (RBC) সংগ্রহ করা হয়, যা বলাই বাহুল্য অগণিত জীবন বাঁচিয়ে চলেছে।
ব্রিটেনের ওই ব্লাড প্রজেক্ট এবং পরবর্তী সমস্ত ব্লাড ব্যাঙ্কগুলি ডক্টর ড্রিউর রক্ত সংরক্ষণের একটি নতুন উপায় আবিষ্কারের উপর নির্ভর করে। নিউইয়র্কের কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়ন করার সময়, তিনি রক্তের বিভিন্ন উপাদান— লোহিত রক্তকণিকা এবং প্লাজমাকে আলাদা এবং হিমায়িত করার বিষয়ে পরীক্ষা করেছিলেন, যা পৃথক উপাদানসমূহ সংরক্ষণ করা এবং পরে তাদের পুনরায় সংযুক্ত করা সম্ভবপর করে তোলে। ডঃ ড্রিউর রক্ত সঞ্চয় করার জন্য নির্দিষ্ট পদ্ধতি তৈরির আগে, প্রায় সমস্ত রক্ত সঞ্চালনই ব্যক্তি থেকে ব্যক্তিতে হয়ে থাকত। চার্লস ড্রিউ ১৯৩৩ সালে কানাডার মন্ট্রিলের ম্যাকগিল বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর মেডিকেল ডিগ্রি অর্জন করেছিলেন। এরপর তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে কলম্বিয়া ইউনিভার্সিটি থেকে প্রথম আফ্রিকান–আমেরিকান হিসেবে তাঁর ডক্টর অফ মেডিকেল সায়েন্স ডিগ্রী অর্জন করেন।
একটু ইতিহাস ঘাঁটলে জানা যায়— সংগৃহীত তথ্য অনুসারে মানব সভ্যতার ইতিহাসে ১৪৯২ সালে সর্বপ্রথম ব্লাড ট্রান্সফিউশনের চেষ্টা করা হয়। তৎকালীন পোপ অষ্টম ইনোসেন্ট কোমায় ডুবে যাওয়ার পর তিনটি ১০ বছর বয়সী বালকের রক্ত মুখ দিয়ে ওনার শরীরে প্রবেশ করানো হয়েছিল। চারজনেই শেষমেশ মারা যান। এরপর প্রথম সম্পূর্ণ নথিভুক্ত ব্লাড ট্রান্সফিউশন ফ্রান্সে পরিচালিত হয়েছিল ১৬৬৭ শতকে। রাজা চতুর্দশ লুইয়ের ডাক্তার একটি ভেড়ার রক্ত এক ১৫ বছর বয়স্ক ছেলের মধ্যে চালনা করেন, এবং সে প্রাণে বেঁচে যায়।
ব্রিটিশ ধাত্রীবিদ্যাবিদ এবং ফিজিওলজিস্ট জেমস ব্লুন্ডেল প্রথম মানবদেহ থেকে মানবদেহে ব্লাড ট্রান্সফিউশন করেন ১৮১৮ সালে।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের আবির্ভাব রক্ত সংগ্রহ ও ব্লাড–ট্রান্সফিউশনের প্রয়োজনীয়তা বহুগুণে বাড়িয়ে দেয়। ১৯১৭ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ‘ক্যামব্রাইয়ের যুদ্ধ’–এর আগে সেনা–ডাক্তাররা সাইট্রেট–গ্লুকোজ দ্রবণ সহযোগে টাইপ-O রক্ত সংগ্রহ ও সংরক্ষণ শুরু করেন।
যদিও তার আগে ট্রান্সফিউশন সরাসরি ধমনী দ্বারা বা পরোক্ষে সিরিঞ্জ সহযোগে হয়ে আসছিল, অসওয়াল্ড হোপ রবার্টসন একটি ট্রান্সফিউশন পরিষেবা তৈরি করতে সক্ষম হন যা ব্লাড ট্রান্সফিউশনের ভবিষ্যত পরিবর্তন করে দেয়। তিনি পূর্বে চিহ্নিত করা Universal (সর্বজনীন) বা O-দাতাদের কাছ থেকে সংগৃহীত রক্ত জীবাণুমুক্ত কাঁচের বোতলে রেখেছিলেন, যা ২৬ দিন পর্যন্ত সেই রক্তকে সতেজ এবং স্থানান্তরযোগ্য রাখতে সক্ষম হয় এবং যেখানে তার প্রয়োজন ছিল সেই সব স্থানে পাঠানো হতে থাকে। ১৯১৭ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়, রবার্টসন ইউএস ফিফ্থ বেস স্টেশন হাসপাতাল এবং হার্ভার্ড মেডিকেল ইউনিট থেকে ‘কানাডিয়ান ক্যাজুয়ালটি ক্লিয়ারিং স্টেশন‘-এ রক্তের স্থানান্তরিত করেছিলেন, যেখানে ২২ ইউনিট Universal-দাতার রক্ত ২০ জন আহত সৈন্যকে পুনরুজ্জীবিত করতে ব্যবহার হয়।
রক্ত পরিবহনের জন্য ব্যবহৃত বোতলগুলি সেই সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে এক অবিশ্বাস্য বৈজ্ঞানিক অগ্রগতি ছিল, কারণ ভেতরে থাকা রক্ত দ্রব্যের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে বেশ কিছু অপেক্ষাকৃত নতুন প্রযুক্তির ব্যবহার হয়েছিল, যেমন জীবাণুমুক্ত তরলের ব্যবহার, অ্যান্টিকোঅ্যাগুলেশন, এবং গ্যাস–হিমায়ন পদ্ধতি (gas refrigeration) দিয়ে তৈরি বরফ সংরক্ষণ করার কাজ ইত্যাদি।
এর পরবর্তীকালে ১৯২২ সালে লন্ডনে প্রথম রক্তদান পরিষেবা তৈরি হয়। স্বেচ্ছাসেবকরা সেসময়ে ২৪–ঘন্টা টেলিফোন কলে থাকতে এবং প্রয়োজনে রক্ত দেওয়ার জন্য স্থানীয় হাসপাতালে ভ্রমণ করতে সম্মত ছিলেন। সমস্ত স্বেচ্ছাসেবক রক্তদাতাদের রোগ–পরীক্ষা করা, তারপর তাদের রক্তের প্রকার নির্ণয় এবং নাম নির্দিষ্ট লগবুকে নথিভুক্ত করানোর মত কাজ সুষ্ঠুভাবে চালাত।
১৯৩০ সালে সোভিয়েতরাই সর্বপ্রথম হাসপাতালে রক্ত সঞ্চালনে ব্যবহারের জন্য রক্ত সংগ্রহ ও সংরক্ষণের সুবিধার একটি চলনসই সংগঠন স্থাপন করে বলে জানা যায়।
এরপর ১৯৩৬ সালে ‘বার্সেলোনা ব্লাড–ট্রান্সফিউশন সার্ভিস‘ রক্ত সংগ্রহ করা, তার পরীক্ষা, রক্তের গ্রুপ অনুসারে আলাদা করে, হিমায়িত ও বোতলে সংরক্ষণ করা ইত্যাদি শুরু করে। শুধু তাই নয়, সেই সংরক্ষিত রক্ত রেফ্রিজারেটর লাগানো যানবাহনের মাধ্যমে, স্প্যানিশ গৃহযুদ্ধের সময় ফ্রন্ট লাইনার হাসপাতালগুলোতেও সরবরাহ করা হতে থাকে।
ভারতে স্বেচ্ছায় রক্তদানের উদ্যোগের প্রথম রেকর্ড ১৯৪২ সালে পাওয়া যায়, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় যখন প্রথম ব্লাড ব্যাঙ্ক কলকাতায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।
চিত্র ও তথ্যসূত্র:
[1] http://www.givingblood.org/about-blood/history-of-blood-banking.aspx
[2] https://www.lib.uchicago.edu/collex/exhibits/dr-bernard-fantus-father-blood-bank/
[3] https://deputyprimeminister.gov.mt/en/nbts/Pages/About-Blood/History-of-Blood.aspx
[4] https://www.jvascsurg.org/article/S0741-5214(12)01122-6/fulltext
[5] https://stanfordbloodcenter.org/100th-anniversary-first-blood-bank/
========================