কোভিড-১৯ মহামারীর বিরুদ্ধে মানব সভ্যতার লড়াই এনে দিল শরীরবিদ্যা ও ঔষধে ২০২৩-এর নোবেল

33 বার লেখাটি পঠিত হয়েছে ~~~

কলমে এলেবেলে  দেবারুন  

~~~~~~~~~~~~~~~~~~~

২০১৯ এর শেষ এবং ২০২০-র প্রথম দিকে শুরু হওয়া কোভিড-১৯ (Covid-19) মহামারীর বিরুদ্ধে কার্যকরী mRNA ভ্যাকসিন আবিষ্কারের জন্য বিজ্ঞানী ক্যাতালিন কারিকো এবং ড্রিউ উইসম্যান- এদের আবিষ্কার খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এই যুগান্তকারী আবিষ্কারের সাথে বিজ্ঞানীদ্বয় দেখিয়েছেন কিভাবে আমাদের ইমিউন সিস্টেম এর সাথে বার্তাবাহী RNA (mRNA) ভ্যাকসিন কাজ করে।

 

মহামারীর আগের ভ্যাকসিন

 

ভ্যাকসিন বা টিকা, কোনো বিশেষ এবং নির্দিষ্ট রোগের বিরুদ্ধে আমাদের রোগ প্রতিরোধী ব্যবস্থাকে উদ্দীপিত করে তোলে। ফলস্বরূপ, যদি ভবিষ্যতেও আমাদের শরীরে ঐ একই রোগ সংক্রামিত হয়, তাহলে আমাদের শরীরে আগে থেকেই তৈরি হয়ে থাকা অ্যান্টিবডি (antibody) ঐ রোগের বিরুদ্ধে আমাদের সুরক্ষা দেয়। এক্ষেত্রে বলা যায় যে, পোলিও, হাম বা পীত জ্বরের বিরুদ্ধে যে ভ্যাকসিনগুলো দীর্ঘকাল ধরে বাজারে উপলব্ধ, তা মৃত বা দুর্বল ভাইরাসের উপর ভিত্তি করে প্রস্তুত করা। প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য, ম্যাক্স থিলার, (Max Theiler) ১৯৫১ সালে পীত জ্বরের (yellow fever) ভ্যাকসিন আবিষ্কার করে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন শারীরবিদ্যা/ওষুধ বিভাগে।

 

বর্তমান যুগে, অনু জীববিদ্যার (molecular biology) অসাধারণ অগ্রগতির জন্য সম্পূর্ণ ভাইরাল উপাদানের (viral components) জায়গায় আলাদা আলাদা ভাইরাল উপাদানের উপর ভিত্তি করে ভ্যাকসিন তৈরি করা হচ্ছে। ভাইরাল জেনেটিক কোড, বিশেষ করে যেগুলো এনকোডিং প্রোটিন (encoding proteins) যা ভাইরাস পৃষ্ঠে (virus surface) উপলব্ধ, এক বিশেষ ধরনের প্রোটিন প্রস্তুত করতে ব্যবহৃত হয়। এই প্রোটিনগুলো, ভাইরাস-অবরোধকারী অ্যান্টিবডিকে (virus-blocking antibodies) উদ্দীপিত করে। এর উদাহরণ হচ্ছে হিউম্যান প্যাপিলোমা ভাইরাস (Human papillomavirus) এবং হেপাটাইটিস-বি এর বিরূদ্ধে প্রস্তুত করা ভ্যাকসিনগুলো। বিকল্পভাবে, ভাইরাল জেনেটিক কোডের অংশগুলো, একটি বাহক ভাইরাস (career virus) এ স্থানান্তর করা যায়, যেটি কম ক্ষতিকর এবং ‘ভেক্টর’ (vector) নামে পরিচিত। ঠিক এই পদ্ধতিই, ইবোলা ভাইরাসের (Ebola virus) বিরুদ্ধে ভ্যাকসিন তৈরিতে অনুসরণ করা হয়েছে। যখনই এই ভেক্টর ভ্যাকসিন আমাদের শরীরে দেওয়া হয়, তখন নির্বাচিত ভাইরাল প্রোটিন আমাদের দেহের কোষে উৎপাদিত হয় এবং সংশ্লিষ্ট ভাইরাসের বিরুদ্ধে রোগ প্রতিরোধক প্রতিক্রিয়াকে উদ্দীপিত করা শুরু করে।

সম্পূর্ন ভাইরাস (whole virus), প্রোটিন (protein) এবং ভেক্টর নির্ভর ভ্যাকসিন বানাতে পর্যাপ্ত পরিমাণে সেল কালচার (cell culture) প্রয়োজন। ফলস্বরূপ, অল্প সময়ে অনেক পরিমাণ ভ্যাকসিন বানানো কঠিন হয়ে পড়ে। এই কারণে, বিজ্ঞানীরা এমন এক পদ্ধতি আবিষ্কার করার চেষ্টা করেন যাতে cell culture এর প্রয়োজন পড়বেনা, যদিও এই পদ্ধতি সমস্যবহুলও বটে।

চিত্র ১: কোভিড-১৯ মহামারীর আগে ভ্যাকসিন তৈরির পদ্ধতি

বার্তাবাহী-আরএনএ (m-RNA) ভ্যাকসিন: এক প্রতিশ্রুতিশীল ধারণা

 

আমাদের কোষে উৎপাদিত জেনেটিক তথ্যসমূহ ট্রান্সক্রিপশন (transcription) পদ্ধতির মাধ্যমে mRNA তে স্থানান্তরিত হয়, যা ট্রান্সলেশন (translation) পদ্ধতির মাধ্যমে প্রোটিন প্রস্তুতির ছাঁচ (template) হিসেবে ব্যবহৃত হয়। ১৯৮০ সাল নাগাদ, cell culture ছাড়াই mRNA প্রস্তুতির জন্য এক পদ্ধতির প্রচলন হয় যাকে ইন ভিট্রো ট্রান্সক্রিপশন (in vitro transcription) বলা হয়। এই পদক্ষেপ অনু জীববিদ্যা ব্যবহারের বিভিন্ন ক্ষেত্রকে সমৃদ্ধ করেছে। এক্ষেত্রে mRNA কে ভ্যাকসিন এবং থেরাপিউটিক (therapeutic) ক্ষেত্রে ব্যবহার করার চেষ্টা শুরু হলেও অন্যান্য বিভিন্ন সমস্যাও ছিলো। এর কারণ, ইন ভিট্রো ট্রান্সক্রিপশন পদ্ধতিতে প্রস্তুত করা mRNA unstable এবং এটা সরবরাহ (deliver) করতে ক্যারিয়ার লিপিড সিস্টেমের (carrier lipid system) আরও উন্নতির দরকার ছিল, যা এটাকে encapsulate করবে। উপরন্তু, এই বিশেষ পদ্ধতিতে তৈরি করা mRNA inflammatory response বা প্রদাহজনিত প্রতিক্রিয়ার উদ্ভব ঘটায়। ফলস্বরূপ, ক্লিনিক্যাল উদ্দেশ্যে m-RNA এর ব্যবহার প্রাথমিকভাবে সীমিতই ছিলো এযাবৎ।

যদিও উপরোক্ত বাধাগুলো হাঙ্গেরিয়ান জীব রসায়নবিদ ক্যাটালিন কারিকো (Katalin Karikó) কে  নিরুৎসাহিত করতে পারেনি। এই বিজ্ঞানী, mRNA কে বিভিন্ন থেরাপির উদ্দেশে ব্যবহারের জন্য গবেষণা শুরু করেছিলেন। ১৯৯০ এর শুরুর দিকে, যখন বিজ্ঞানী কারিকো পেন্সিলভ্যানিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে সহকারী অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত ছিলেন, তখন mRNA কে থেরাপিউটিক ব্যবহারের গবেষণার জন্য ফান্ড (fund) আনতে কিছু সমস্যার সম্মুখীন হন, কারণ তিনি উপর মহলে এই গবেষণার গুরুত্ব বোঝাতে ব্যর্থ হন। যদিও তিনি এর কার্যকারিতা সম্পর্কে সম্পূর্ণ আত্মবিশ্বাসী ছিলেন। এই সময়ে কারিকোর সহকর্মী ছিলেন ইমিউনোলজিস্ট (immunologist) ড্রিউ উইসম্যান। উইসম্যান ডেনড্রাইটিক কোষ (Dendritic cells) নিয়ে গবেষণা করছিলেন, যেগুলো রোগ প্রতিরোধক ক্ষমতা বিশ্লেষণ করতে গুরুত্বপূর্ন ভূমিকা গ্রহণ করে। এছাড়াও, এই কোষ vaccine induced রোগ প্রতিরোধক ক্ষমতা উদ্দীপিত করতে সাহায্য করে। এই নতুন ধারণা উদ্ভবের কারণে, এই দুজন বিজ্ঞানী, কিভাবে বিভিন্ন RNA অনু immune system এর সাথে প্রতিক্রিয়া করে, তা নিয়ে গবেষণা করতে উদ্যোগী হন।

 

গবেষণায় বিপ্লব

 

গবেষণায় এই দুজন বিজ্ঞানী লক্ষ্য করেন যে ইন ভিট্রো পদ্ধতিতে ট্রানস্ক্রাইব করা mRNA কে, ডেনড্রাইটিক কোষগুলো বহিরাগত বস্ত (foreign substance) হিসেবে চিহ্নিত করেছে। যার ফলস্বরূপ, inflammatory signal এর নিষ্কাশন শুরু হয়। তাঁরা বিস্ময়ের সাথে লক্ষ্য করেন যে, স্তন্যপায়ী কোষ থেকে তৈরী করা mRNA এর ক্ষেত্রে এটা না হলেও, ইন ভিট্রো পদ্ধতি অবলম্বন করে transcribe করা mRNA এর ক্ষেত্রেই এই প্রতিক্রিয়া হচ্ছে। কারিকো এবং উইসম্যান অনুভব করেন যে কিছু বিশেষ বৈশিষ্ট্যের মাধ্যমেই বিভিন্ন প্রকার m-RNA কে একে ওপরের থেকে আলাদা করা সম্ভব।

 

RNA চারটি নাইট্রোজেনঘটিত বেসের (nitrogenous base) সমন্বয়ে গঠিত – Adenine, Guanine, Cytosine, এবং Uracil। কারিকো এবং উইসম্যান জানতেন যে স্তন্যপায়ী কোষ থেকে প্রস্তুত করা RNA তে ঘন ঘন রাসায়নিক পরিবর্তন ঘটে, যা ইন ভিট্রো পদ্ধতিতে তৈরি করা mRNA তে হয়না। তাঁরা ভেবেছিলেন যে এক্ষেত্রে ইন ভিট্রো পদ্ধতির mRNA বেসগুলো রাসায়নিক পরিবর্তন ছাড়া যদি ওই অবাঞ্ছিত inflammatory response এর প্রতিক্রিয়া ব্যাখ্যা করতে পারে। বিষয়টা বোঝার জন্য তাঁরা একটা পরীক্ষা করলেন। mRNA এর বিভিন্ন প্রতিলিপি (variant) গঠন করে, প্রত্যেকটার বেসে আলাদা আলাদা রাসায়নিক পরিবর্তন ঘটান ও ডেনড্রাইটিক কোষে সরবরাহ করেন। পরীক্ষার ফলাফল ছিলো চমকপ্রদ। যখন এই রাসায়নিকভাবে পরিবর্তিত বেসগুলো mRNA ঢোকানো হয়, দেখা যায় inflammatory response প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে। কোষের কিভাবে বিভিন্ন mRNA কে চিহ্নিত করে এবং প্রতিক্রিয়া দেয়, সেটা বোঝার ক্ষেত্রে এই পরীক্ষা অসাধারন ভূমিকা রাখে। বিজ্ঞানীদ্বয় উপলব্ধি করেন যে, mRNA কে থেরাপিউটিক হিসেবে ব্যবহার করার জন্য, তাঁদের আবিষ্কার খুবই গুরুত্বপূর্ণ হতে চলেছে। তাঁদের এই গবেষণার প্রাথমিক ফলাফল, মহামারীর পনেরো বছর আগে, ২০০৫ সালে প্রকাশিত হয়।

চিত্র ২: চারটে আলাদা বেসের সমন্বয়ে তৈরী mRNA এর দুটো বেস পরিবর্তন করে, বিজ্ঞানীরা আবিষ্কার করেন যে এই mRNA অনু, প্রদাহজনিত ক্রিয়া- সংকেত অনুর নিঃস্বরণ (inflammatory action-secretion of signalling molecules) বন্ধ করতে বিশেষ উপযোগী। এছাড়াও mRNA কে কোষে প্রবেশ করানো হলে, তা প্রোটিনের উৎপাদন বৃদ্ধি করতেও কার্যকরী ভূমিকা পালন করে।

২০০৮ এবং ২০১০ সালে প্রকাশিত গবেষণাপত্রে কারিকো এবং উইসম্যান দেখিয়েছেন যে, বেস পরিবর্তনের সাথে সাথে উৎপাদিত mRNA থেকে প্রোটিন উৎপাদন, অপরিবর্তিত mRNA এর থেকে বেশী বৃদ্ধি করে। প্রোটিন উৎপাদন নিয়ন্ত্রণ করে এমন একটি উৎসেচকের (enzyme) সক্রিয়করন (activation) কম হওয়ার জন্যই উপরোক্ত ফলাফল দেখা গেছিল। এখানে তাঁরা বেস পরিবর্তনের মাধ্যমেই inflammatory response হ্রাস করেন ও প্রোটিনের উৎপাদন বাড়িয়ে তোলেন। এইভাবে mRNA কে ক্লিনিক্যালভাবে প্রয়োগের জন্য উপযুক্ত উপায় আবিষ্কার করেন।

 

mRNA ভ্যাকসিনের বহুল সম্ভাবনা

 

সময়ের সাথে সাথে mRNA প্রযুক্তির উপর আরও গবেষণা শুরু হয় এবং ২০১০ সাল নাগাদ বিভিন্ন জীবপ্রযুক্তি ও ওষুধ কোম্পানী এই পদ্ধতির আরও উন্নতির জন্য সচেষ্ট হয়। জিকা ভাইরাস (Zika virus) এবং মার্স-কোভ (MERS-CoV) এর বিরুদ্ধে এই পদ্ধতি অনুসরণ করে ভ্যাকসিন বানানো হয়। এর মধ্যে দ্বিতীয়টা ছিলো সার্স-কোভ-২ (SARS-CoV-2) এর সাথে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কযুক্ত। মহামারীর প্রাদুর্ভাব ঘটার পরে, দুটো বেসের পরিবর্তন করে, সার্স-কোভ-২ এর পৃষ্ঠে অবস্থিত প্রোটিন এনকোড করতে পারে এমন mRNA ভ্যাকসিন প্রস্তুত করা হয় খুবই দ্রুত গতিতে। এইভাবে প্রস্তুতকৃত দুটো ভ্যাকসিনেরই কার্যকারিতা শতকরা ৯৫ ভাগের আশেপাশে ছিলো এবং ভ্যাকসিন দুটো ব্যবহারের অনুমোদন পায় ২০২০ সালের ডিসেম্বর নাগাদ।

সময়ের সাথে সাথে গবেষণার উন্নতি উন্নতি হওয়ার কারণে, mRNA প্রস্তুতির সময়সীমাও আরও কমেছে। ফলস্বরূপ, অন্যান্য বিভিন্ন সংক্রামক রোগের বিরুদ্ধে mRNA প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে ভ্যাকসিন তৈরির চেষ্টা চলছে। ভবিষ্যতে এই প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে বিভিন্ন থেরাপিউটিক প্রোটিন সরবরাহ করতে এবং ক্যান্সারের চিকিৎসা করার জন্য ব্যবহার করা যেতে পারে।

বিজ্ঞানী ক্যাতালিন কারিকো এবং ড্রিউ উইসম্যান, তাঁদের এই অমূল্য মৌলিক গবেষণার মাধ্যমে, বর্তমান সময়ের অন্যতম গুরুত্বপূর্ন স্বাস্থ্য সংকটের সমাধান করেছেন।

Leave a Reply

free hit counter